কলা গাছের রোগ ও তার প্রতিকার সমূহ
বাংলাদেশের কৃষিতে কলা একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ফল। দেশের প্রায় সব অঞ্চলে কলার চাষ করা হয়। এটি শুধু সুস্বাদুই নয় বরং অর্থনৈতিকভাবেও চাষিদের জন্য লাভজনক একটি ফসল। কলা গাছ দ্রুত বৃদ্ধি পায় এবং সঠিক যত্ন নিলে কয়েক মাসের মধ্যেই ফলন দিতে সক্ষম হয়। বাংলাদেশের আবহাওয়া কলা চাষের জন্য উপযোগী হলেও অনেকে সঠিক নিয়ম মেনে বাগান পরিচর্যা করতে না পারায় বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হন। বিশেষ করে রোগবালাই এবং কীটপতঙ্গ আক্রমণের কারণে উৎপাদন অনেক সময় কমে যায়।
কলা গাছের যত্ন নেওয়ার সময় শুরুতেই সঠিক জমি নির্বাচন, সার প্রয়োগ, পানি ব্যবস্থাপনা এবং রোগ প্রতিরোধের কৌশল মেনে চলা জরুরি। অধিকাংশ কৃষক কলা চাষ করেন গ্রামীণ খামার বা আঙিনার জমিতে। তবে এখন বাণিজ্যিকভাবে অনেকেই কলার বাগান তৈরি করছেন। তাই কলা বাগানে রোগ হলে দ্রুত তা নির্ণয় করে সঠিক প্রতিকার নিতে না পারলে ফলন নষ্ট হয়ে যায় এবং চাষি আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েন।
বিশেষত কলা গাছে সিগাটোকা রোগ, কলার ছত্রাকজনিত রোগ, পাতা কুঁকড়ে যাওয়া, ছত্রাকের দাগ, কান্ড পচা, গাছ শুকিয়ে যাওয়া ইত্যাদি সমস্যা দেখা দেয়। এই সব রোগের কারণ, লক্ষণ ও প্রতিকার জানা থাকলে সহজেই প্রতিরোধ করা সম্ভব। এ কারণে কলা গাছের রোগ ও তার প্রতিকার সমূহ জানা প্রতিটি কৃষকের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয়।
কৃষকদের মনে রাখা উচিত, কলা গাছ শুধু সার ও পানি দিলেই হবে না, বরং সময়মতো রোগ শনাক্ত করা এবং উপযুক্ত পদক্ষেপ নেওয়া ছাড়া ভালো ফলন পাওয়া সম্ভব নয়। তাই আজকের এই আলোচনায় আমরা বিস্তারিতভাবে দেখব— কলা বাগানে সার দেওয়ার নিয়ম, কলা গাছের রোগ ও তার প্রতিকার সমূহ , সিগাটোকা রোগের প্রতিকারসহ আরও অনেক বিষয়।
কলা বাগানে সার দেওয়ার নিয়ম?

কলা গাছের সঠিক বৃদ্ধি ও ভালো ফলনের জন্য সারের ভূমিকা অপরিসীম। বাংলাদেশে প্রচলিতভাবে জৈব সার ও রাসায়নিক সার উভয়ই ব্যবহার করা হয়। জৈব সার যেমন গোবর, কম্পোস্ট ও কেঁচো সার কলা চাষের জন্য অত্যন্ত উপকারী। এগুলো মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি করে এবং গাছকে রোগ প্রতিরোধী করতে সাহায্য করে। অপরদিকে রাসায়নিক সার যেমন ইউরিয়া, টিএসপি, এমওপি নির্দিষ্ট মাত্রায় প্রয়োগ করলে কলা গাছ দ্রুত বাড়ে এবং সুস্থ থাকে।
প্রথমেই জমি প্রস্তুতের সময় ভালোভাবে জৈব সার মিশিয়ে দিতে হবে। সাধারণত প্রতি গর্তে ১০-১৫ কেজি গোবর সার দেওয়া হয়। এরপর কলা গাছ লাগানোর ৩০-৪০ দিন পর থেকে নিয়মিত সার দেওয়া শুরু করতে হয়। ইউরিয়া, টিএসপি ও এমওপি সমন্বিতভাবে ব্যবহার করতে হয়। তবে একবারে বেশি সার না দিয়ে ভাগ ভাগ করে প্রয়োগ করা উচিত। এতে গাছ সহজে খাবার গ্রহণ করতে পারে এবং মাটিতে লবণাক্ততা তৈরি হয় না।
সার প্রয়োগের পাশাপাশি সেচের দিকেও নজর দিতে হবে। সার দেওয়ার পর হালকা সেচ দিলে গাছ সার দ্রুত টেনে নেয়। কলা গাছে প্রতি মাসে অন্তত একবার সার প্রয়োগ করা ভালো। তবে ফুল আসার সময় ও ফল ধরার সময় বিশেষভাবে সার দিতে হবে। এসময় অতিরিক্ত পটাশ সার দিলে ফল বড় হয়, মিষ্টি হয় এবং বাজারে চাহিদা বাড়ে।
কৃষকরা যদি সঠিক নিয়মে সার ব্যবহার করেন তবে কলা গাছ রোগ প্রতিরোধে সক্ষম হবে। কারণ, সুষম সার প্রয়োগ গাছকে পুষ্ট রাখে এবং রোগবালাই সহজে আক্রমণ করতে পারে না। তাই সার ব্যবস্থাপনা কলা চাষের সফলতার অন্যতম শর্ত।
কলা গাছের রোগ ও তার প্রতিকার সমূহ ?

কলা গাছের বিভিন্ন রোগ সঠিক সময়ে শনাক্ত না করলে বড় ধরনের ক্ষতি হতে পারে। নিচে ১০টি প্রধান রোগ এবং প্রতিকার নিয়ে আলোচনা করা হলো—
১. সিগাটোকা রোগ
সিগাটোকা রোগ কলা গাছের সবচেয়ে মারাত্মক রোগগুলোর একটি, যা বিশ্বব্যাপী কলা চাষিদের জন্য বড় ধরনের হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই রোগ ছত্রাক দ্বারা সৃষ্ট হয় এবং এর বৈজ্ঞানিক নাম হলো Mycosphaerella musicola (যা Yellow Sigatoka) অথবা Mycosphaerella fijiensis (যা Black Sigatoka নামে পরিচিত)। বাংলাদেশে মূলত উভয় প্রকার রোগ দেখা যায়, তবে আর্দ্র পরিবেশে ব্ল্যাক সিগাটোকা রোগ সবচেয়ে বেশি বিস্তার লাভ করে।
এই রোগ প্রথমে কলা গাছের পাতায় আক্রমণ করে। ছোট ছোট লম্বাটে বাদামী দাগ তৈরি হয়। কয়েক দিনের মধ্যে দাগগুলো গাঢ় বাদামী থেকে কালো রঙ ধারণ করে এবং একত্রে মিলিত হয়ে বড় আকার ধারণ করে। পাতা শুকিয়ে বাদামী হয়ে যায় এবং ধীরে ধীরে পুরো গাছ দুর্বল হয়ে পড়ে। সালোকসংশ্লেষণ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় গাছের স্বাভাবিক বৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হয়। ফলে ফল ছোট হয়, স্বাদ কমে যায় এবং বাজারজাতের উপযোগিতা হারায়।
ক্ষতির দিক থেকে বলা যায়, আক্রান্ত গাছে উৎপাদন প্রায় ৫০-৭০% পর্যন্ত কমে যেতে পারে। গাছ থেকে পাওয়া ফল বাজারে বিক্রি করা গেলেও মান খারাপ হওয়ায় দাম পাওয়া যায় না। অনেক সময় অল্প বয়সী গাছও মারা যায়। এতে কৃষক আর্থিকভাবে মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন হন।
কারণ ও বিস্তার
সিগাটোকা রোগ মূলত আর্দ্র ও উষ্ণ পরিবেশে ছড়ায়। অতিরিক্ত বৃষ্টিপাত, ঘন বাগান, আলো-বাতাস প্রবেশ না করা জমি, এবং জমিতে পানি জমে থাকা রোগ বিস্তারের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করে। বৃষ্টির পানির ছিটে এবং বাতাসের মাধ্যমে রোগ দ্রুত এক গাছ থেকে আরেক গাছে ছড়িয়ে পড়ে।
লক্ষণসমূহ
- পাতায় ছোট ছোট বাদামী দাগ সৃষ্টি হয়।
- দাগগুলো ক্রমে বড় হয়ে কালো দাগে পরিণত হয়।
- পাতা শুকিয়ে বাদামী হয়ে যায়।
- নতুন পাতা স্বাভাবিকভাবে গজায় না, গজালেও দুর্বল হয়।
- গাছের ফলন কমে যায় এবং ফল ছোট হয়।
প্রতিকার ও প্রতিরোধ ব্যবস্থা
১. আক্রান্ত পাতা কেটে ফেলে দিতে হবে যাতে ছত্রাক ছড়াতে না পারে।
২. জমি সবসময় পরিষ্কার ও আগাছামুক্ত রাখতে হবে।
৩. কলা বাগানে আলো-বাতাস প্রবেশ নিশ্চিত করতে গাছের দূরত্ব বজায় রাখতে হবে।
৪. পানি নিষ্কাশনের ভালো ব্যবস্থা রাখতে হবে, যাতে পানি জমে না থাকে।
৫. রোগমুক্ত ও টিস্যু কালচার কলার চারা ব্যবহার করতে হবে।
৬. ম্যানকোজেব, কপার অক্সিক্লোরাইড, প্রপিকোনাজল জাতীয় ছত্রাকনাশক নিয়মিত স্প্রে করতে হবে।
৭. প্রতি ১০-১৫ দিন অন্তর গাছ পর্যবেক্ষণ করে রোগের প্রাথমিক লক্ষণ শনাক্ত করতে হবে।
৮. জৈব ছত্রাকনাশক যেমন ট্রাইকোডার্মা ব্যবহার করলে দীর্ঘমেয়াদি সুফল পাওয়া যায়।
৯. ভারসাম্যপূর্ণ সার প্রয়োগ করতে হবে। বিশেষ করে পটাশ ও জৈব সার বেশি দিলে গাছ রোগ প্রতিরোধে সক্ষম হয়।
১০. কৃষি বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিয়ে সঠিক কীটনাশক ও ছত্রাকনাশক ব্যবহার করা উচিত।
২. কলা কান্ড পচা রোগ
কলা কান্ড পচা রোগ বাংলাদেশের কলা বাগানে খুব পরিচিত একটি রোগ। কৃষকরা সাধারণত এটিকে পচন রোগ হিসেবেই চেনে। এই রোগ প্রধানত ছত্রাক ও ব্যাকটেরিয়ার সংমিশ্রণে হয়ে থাকে, তবে সাধারণত Fusarium spp., Erwinia spp. নামক জীবাণুই এর মূল কারণ। বিশেষ করে বর্ষা মৌসুমে এবং যেখানে পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা ভালো নয়, সেখানে এই রোগ দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে।
আক্রমণের ধরন ও লক্ষণ
কলা গাছের ছদ্মকান্ড বা মূলকান্ডে প্রথমে হালকা বাদামী রঙের দাগ দেখা দেয়। পরে সেই দাগ ধীরে ধীরে কালচে হয়ে যায় এবং নরম হয়ে পচতে শুরু করে। আক্রান্ত জায়গায় দুর্গন্ধ ছড়ায় এবং ভিজে কাদা-কাদা হয়ে যায়। ধীরে ধীরে পুরো কান্ড দুর্বল হয়ে পড়ে, গাছ ভেঙে পড়ে যায়। অনেক সময় রোগ শুরু হলে পাতা হলদেটে হয়ে যায়, শুকিয়ে ঝুলে পড়ে। যদি গাছে ফল থাকে তবে ফল সঠিকভাবে পরিপক্ব হতে পারে না।
ক্ষতির পরিমাণ
এই রোগে আক্রান্ত গাছ খুব দ্রুত মরে যায়। অনেক ক্ষেত্রে কৃষক বুঝে ওঠার আগেই পুরো জমির একাংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে যায়। ফলন ৪০-৬০% পর্যন্ত কমে যায়। ফল ছোট হয়, বাজারে বিক্রির উপযোগী থাকে না। কখনও কখনও পুরো বাগানই নষ্ট হয়ে যায়।
কারণ ও বিস্তার
১. জমিতে পানি জমে থাকা।
২. আগের বছরের আক্রান্ত অবশিষ্টাংশ ঠিকমতো না পোড়ানো বা পরিষ্কার না করা।
৩. ভারী বৃষ্টিপাত ও কাদা জমা থাকা।
৪. পোকামাকড়ের আঘাতের মাধ্যমে রোগজীবাণু প্রবেশ করা।
৫. টিস্যু কালচারবিহীন বা রোগাক্রান্ত চারা ব্যবহার করা।
রোগের প্রতিকার ও প্রতিরোধ ব্যবস্থা
১. আক্রান্ত গাছ দ্রুত জমি থেকে তুলে ফেলে দিতে হবে।
২. কান্ডে আক্রান্ত অংশ ছুরি দিয়ে কেটে বোরডো মিশ্রণ দিয়ে প্রলেপ দিতে হবে।
৩. পানি জমে না থাকার মতো ড্রেনেজ ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।
৪. নতুন কলা বাগান করার আগে জমি জীবাণুমুক্ত করতে হবে।
৫. বাগান সবসময় পরিষ্কার রাখতে হবে এবং আগাছা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
৬. গাছের গোড়ায় নিয়মিত জৈব সার প্রয়োগ করলে মাটির গুণগত মান উন্নত হয় এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ে।
৭. জমিতে ট্রাইকোডার্মা জাতীয় জৈব ছত্রাকনাশক ব্যবহার করলে দীর্ঘমেয়াদে ভালো ফল পাওয়া যায়।
৮. রোগমুক্ত ও টিস্যু কালচার চারা ব্যবহার করা আবশ্যক।
৯. ক্ষেতে প্রয়োজনীয় দূরত্ব বজায় রেখে গাছ লাগাতে হবে, যাতে বাতাস চলাচল করে।
১০. কৃষি বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিয়ে সঠিক কীটনাশক/ছত্রাকনাশক প্রয়োগ করতে হবে।
অতিরিক্ত করণীয়
- বৃষ্টির মৌসুমে জমি নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করতে হবে।
- ফসল তোলার পর জমি চাষ দিয়ে রোগাক্রান্ত অবশিষ্টাংশ ধ্বংস করতে হবে।
- মাটির অম্লতা (pH) নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। প্রয়োজনে চুন প্রয়োগ করা যেতে পারে।
৩. কলা ব্যাকটেরিয়াল উইল্ট বা মকো রোগ
কলা ব্যাকটেরিয়াল উইল্ট, যাকে কৃষকেরা অনেক সময় মকো রোগ নামে চেনে, এটি কলা গাছের জন্য সবচেয়ে ভয়াবহ রোগগুলোর একটি। এ রোগের মূল জীবাণু হলো Ralstonia solanacearum নামক ব্যাকটেরিয়া। এটি মাটিতে, পানিতে ও আগাছায় দীর্ঘদিন বেঁচে থাকতে পারে এবং পরবর্তী মৌসুমে নতুন কলা গাছে আক্রমণ করতে সক্ষম। রোগটি প্রধানত কলা গাছের জাইলেম টিস্যুতে আক্রমণ করে, ফলে গাছের ভেতরে পানি ও খাদ্য পরিবহন বন্ধ হয়ে যায়।
আক্রমণের ধরন ও প্রাথমিক লক্ষণ
মকো রোগে আক্রান্ত কলা গাছ প্রথমে খুব স্বাভাবিক মনে হয়, তবে কিছুদিনের মধ্যেই উপরের পাতাগুলো হঠাৎ ঝিমিয়ে পড়ে। পাতার ডগা থেকে হলুদ হয়ে ধীরে ধীরে গোটা পাতা শুকিয়ে যায়। অনেক সময় গাছ হঠাৎ ভেঙে পড়ে। কান্ড কেটে দেখলে ভেতরে বাদামী বা কালো দাগ দেখা যায় এবং কান্ড থেকে দুর্গন্ধযুক্ত তরল বের হয়।
ফলন ও অর্থনৈতিক ক্ষতি
মকো রোগে আক্রান্ত গাছে ফল প্রায় হয়ই না। ফল ধরলেও দ্রুত পচে যায়। রোগটি একবার বাগানে ঢুকে পড়লে নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে পড়ে। একটি বাগানে এ রোগ ছড়িয়ে পড়লে ৮০-৯০% পর্যন্ত ক্ষতি হতে পারে। এতে কৃষকের বছরের পরিশ্রম ও অর্থ বিনিয়োগ একেবারেই ব্যর্থ হয়ে যায়।
রোগ বিস্তারের কারণ
১. মাটি ও সেচের পানির মাধ্যমে ব্যাকটেরিয়া ছড়িয়ে পড়ে।
২. আক্রান্ত গাছের অবশিষ্টাংশ জমিতে পড়ে থাকলে জীবাণু দীর্ঘদিন সক্রিয় থাকে।
৩. কৃষকের ব্যবহৃত কাঁচি, দা, ছুরি ইত্যাদির মাধ্যমে রোগ অন্য গাছে সংক্রমিত হয়।
৪. নেমাটোড ও অন্যান্য পোকামাকড়ের আক্রমণের কারণে গাছ দুর্বল হয়ে গেলে এ রোগ সহজে আক্রমণ করে।
৫. রোগাক্রান্ত এলাকা থেকে আনা কলার চারা ব্যবহার করলে পুরো জমি ঝুঁকির মধ্যে পড়ে।
রোগ শনাক্ত করার উপায়
- কান্ড কেটে দেখলে ভেতরে বাদামী ও কালো রঙের রেখা দেখা যায়।
- গাছের গোড়া থেকে হলদে তরল বের হয়।
- পাতা হঠাৎ নুয়ে পড়ে, শুকিয়ে ঝুলে যায়।
- ফলের গুচ্ছে দাগ ও অকাল পচন দেখা দেয়।
প্রতিকার ও প্রতিরোধ ব্যবস্থা
১. আক্রান্ত গাছ চিহ্নিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তা কেটে ফেলে পুড়িয়ে ফেলতে হবে।
২. জমিতে রোগমুক্ত টিস্যু কালচার চারা ব্যবহার করতে হবে।
৩. নতুন বাগান করার আগে জমি জীবাণুমুক্ত করতে হবে। প্রয়োজনে চুন ও জৈব সার প্রয়োগ করতে হবে।
৪. ফসল তোলার পর জমি গভীরভাবে চাষ দিয়ে সূর্যালোকে ফেলে রাখতে হবে, যাতে ব্যাকটেরিয়া ধ্বংস হয়।
৫. আক্রান্ত জমিতে কয়েক বছর কলা না চাষ করে ডাল জাতীয় বা অন্যান্য ফসল চাষ করতে হবে।
৬. বাগানে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি সবসময় জীবাণুমুক্ত রাখতে হবে।
৭. জমিতে অতিরিক্ত পানি জমতে দেওয়া যাবে না।
৮. প্রতিরোধী জাতের কলা চাষ করা গেলে দীর্ঘমেয়াদে সুফল পাওয়া যায়।
৯. নেমাটোড নিয়ন্ত্রণ করতে হবে, কারণ তারা ব্যাকটেরিয়া ছড়াতে সাহায্য করে।
১০. কৃষি কর্মকর্তার পরামর্শ নিয়ে কপার অক্সিক্লোরাইড জাতীয় ব্যাকটেরিনাশক ব্যবহার করা যেতে পারে।
অতিরিক্ত করণীয়
- প্রতি ১০-১২ দিনে বাগান পর্যবেক্ষণ করতে হবে।
- আক্রান্ত এলাকায় কাজ করার পর অন্য বাগানে না গিয়ে প্রথমে হাত, পা, পোশাক পরিষ্কার করতে হবে।
- রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে জৈব সার ও মাইক্রোবিয়াল সার ব্যবহার করা উচিত।
৪. কলা পাতায় মোজাইক ভাইরাস রোগ
কলা পাতায় মোজাইক রোগ কলা গাছের জন্য একটি মারাত্মক ভাইরাসজনিত রোগ, যা গাছের স্বাভাবিক বৃদ্ধি ও ফলনকে মারাত্মকভাবে বাধাগ্রস্ত করে। এর মূল কারণ হলো Banana bunchy top virus (BBTV) অথবা অন্যান্য মোজাইক সৃষ্টিকারী ভাইরাস। বাংলাদেশসহ পৃথিবীর প্রায় সব কলা উৎপাদনকারী অঞ্চলে এ রোগ দেখা যায়। সবচেয়ে ভয়াবহ দিক হলো—এ রোগ একবার গাছে লাগলে তা আর নিরাময় করা যায় না, কেবল প্রতিরোধের ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব।
রোগ বিস্তারের ধরন মোজাইক রোগ মূলত কীটপতঙ্গের মাধ্যমে ছড়ায়। বিশেষ করে এফিড (Pentalonia nigronervosa) নামক ছোট কীট এ রোগ ছড়ানোর মূল বাহক। আক্রান্ত জমির চারা থেকে সুস্থ জমিতে সহজেই রোগ ছড়িয়ে পড়ে। অনেক সময় কৃষক অজান্তে আক্রান্ত গাছের চারা ব্যবহার করলে পুরো বাগান আক্রান্ত হয়ে যায়।
আক্রমণের লক্ষণ
১. কলা পাতায় সবুজ ও হলুদ দাগ দাগ ছোপ তৈরি হয়, যা মোজাইকের মতো দেখা যায়।
২. নতুন পাতা স্বাভাবিকভাবে গজায় না, কুঁচকে যায় এবং ছোট আকার ধারণ করে।
৩. গাছ খাটো হয়ে যায়, পাতার গুচ্ছ ঘন হয়ে উপরে জমা হয়, যাকে “bunchy top” বলা হয়।
৪. গাছ দুর্বল হয়ে পড়ে এবং ফুল বা ফল গজাতে দেরি হয়।
৫. ফলন মারাত্মকভাবে কমে যায়।
ক্ষতির দিক
মোজাইক ভাইরাস আক্রান্ত গাছ খুব কম ফল দেয়। গাছের স্বাভাবিক আয়ু কমে যায়। ফলে কৃষকের উৎপাদন ব্যয় বাড়ে কিন্তু ফলন কমে যায়। একটি জমিতে যদি এ রোগ ছড়িয়ে পড়ে তবে ৭০-৮০% পর্যন্ত ক্ষতি হতে পারে। এ কারণে অনেক কৃষক পুরো জমি ফেলে দিতে বাধ্য হন।
রোগ বিস্তারের কারণ
১. এফিড নামক পোকা ভাইরাস ছড়ায়।
২. আক্রান্ত চারা ব্যবহার।
৩. আগাছা ও অন্য আক্রান্ত উদ্ভিদের উপস্থিতি।
৪. জমিতে সঠিক পরিচর্যার অভাব।
প্রতিকার ব্যবস্থা
১. রোগ দেখা দিলে আক্রান্ত গাছ দ্রুত কেটে পুড়িয়ে ফেলতে হবে।
২. বাগানে এফিড দমন করতে হবে। এজন্য নিম তেল, জৈব কীটনাশক বা ইমিডাক্লোপ্রিড জাতীয় কীটনাশক ব্যবহার করা যেতে পারে।
৩. রোগমুক্ত টিস্যু কালচার চারা ব্যবহার করতে হবে।
৪. জমি সবসময় পরিষ্কার রাখতে হবে এবং আগাছা দমন করতে হবে।
৫. জমিতে সঠিক দূরত্বে চারা লাগাতে হবে যাতে আলো-বাতাস চলাচল করে।
৬. বাগান নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করতে হবে, যাতে রোগ প্রথমেই ধরা পড়ে।
৭. সংক্রমিত জমিতে চারা বা কলা গাছ অন্য জমিতে স্থানান্তর করা যাবে না।
৮. কৃষি বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিয়ে সঠিক কীটনাশক ব্যবহার করতে হবে।
অতিরিক্ত করণীয়
- প্রতিরোধী জাতের কলা চাষ করা উচিত।
- জৈব সার ব্যবহার করলে গাছের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়।
- এফিড দমনে লেবুপাতার নির্যাস বা জৈব স্প্রে ব্যবহার করা যেতে পারে।
- আক্রান্ত জমিতে অন্তত ২-৩ বছর কলা চাষ না করে অন্য ফসল চাষ করতে হবে।
৫. কলা পাতায় স্ট্রিক ভাইরাস রোগ
কলা পাতায় স্ট্রিক ভাইরাস রোগ বাংলাদেশে কলা গাছের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ভাইরাসজনিত রোগ। এই রোগ মূলত Banana streak virus (BSV) দ্বারা সংঘটিত হয়। এটি একটি ডিএনএ ভাইরাস এবং অনেক সময় জেনেটিক উপায়ে গাছের ভেতরেও থেকে যেতে পারে। ফলে সুস্থ মনে হওয়া গাছ থেকেও নতুন প্রজন্মে ভাইরাস ছড়িয়ে পড়তে পারে। কলা চাষের ক্ষেত্রে এই রোগ উৎপাদনশীলতা কমিয়ে কৃষককে আর্থিকভাবে বড় ক্ষতির মুখে ফেলে দেয়।
রোগ বিস্তারের ধরন এই ভাইরাস মূলত দুইভাবে ছড়ায়। প্রথমত, এফিড জাতীয় পোকা (বিশেষ করে black aphid) এ ভাইরাসের বাহক হিসেবে কাজ করে। দ্বিতীয়ত, কৃষকেরা যখন রোগাক্রান্ত গাছের চারা ব্যবহার করেন, তখন অজান্তেই ভাইরাস নতুন জমিতে ছড়িয়ে যায়। এছাড়াও কলা টিস্যু কালচার সঠিকভাবে না হলে ভাইরাস থেকে যেতে পারে।
রোগের প্রাথমিক লক্ষণ
১. কলা পাতায় হালকা সবুজ থেকে হলুদ রঙের দাগ বা স্ট্রিক দেখা যায়।
২. পাতার শিরা বরাবর সরু দাগ তৈরি হয়, যা পরে বড় আকার ধারণ করে।
৩. পাতা কুঁচকে যায় ও আকারে ছোট হয়ে যায়।
৪. আক্রান্ত গাছ দুর্বল হয়ে পড়ে, নতুন পাতা স্বাভাবিকভাবে জন্মায় না।
৫. গাছের বৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হয় এবং অনেক সময় ফুল ও ফল আসেই না।
ফলন ও অর্থনৈতিক ক্ষতি
স্ট্রিক ভাইরাস আক্রান্ত গাছ সাধারণত ছোট আকারের হয় এবং স্বাভাবিক ফলন দিতে পারে না। আক্রান্ত গাছের ফল ছোট হয়, মান খারাপ হয় এবং বাজারজাতকরণের যোগ্য থাকে না। একটি জমিতে যদি ৩০-৪০% গাছ আক্রান্ত হয় তবে ফলন প্রায় অর্ধেকে নেমে যায়। অনেক সময় কৃষকদের পুরো জমিই বাদ দিতে হয়।
রোগ বিস্তারের কারণ
১. এফিড পোকা ভাইরাস ছড়ায়।
২. রোগাক্রান্ত চারা ব্যবহার।
৩. জমি বা বাগান অপরিচ্ছন্ন থাকা।
৪. টিস্যু কালচার সঠিকভাবে না হওয়া।
প্রতিকার ব্যবস্থা
১. রোগ শনাক্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আক্রান্ত গাছ কেটে ফেলে পুড়িয়ে ফেলতে হবে।
২. রোগমুক্ত টিস্যু কালচার চারা ব্যবহার করতে হবে।
৩. এফিড নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। এজন্য জৈব কীটনাশক (নিম তেল, লেবুপাতা নির্যাস) ব্যবহার করা যেতে পারে। প্রয়োজনে ইমিডাক্লোপ্রিড জাতীয় কীটনাশক ব্যবহার করা যায়।
৪. জমি সবসময় পরিষ্কার রাখতে হবে। আগাছা দমন করতে হবে, কারণ অনেক আগাছাও ভাইরাস বহন করতে পারে।
৫. আক্রান্ত জমিতে অন্তত ২-৩ বছর কলা না লাগিয়ে অন্যান্য ফসল চাষ করতে হবে।
৬. নিয়মিত বাগান পর্যবেক্ষণ করতে হবে।
৭. কৃষি বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিয়ে সঠিক প্রতিকার গ্রহণ করা উচিত।
অতিরিক্ত করণীয়
- প্রতিরোধী জাতের কলা চাষ করা উচিত।
- জৈব সার ব্যবহার করলে গাছের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ে।
- টিস্যু কালচার নার্সারি থেকে চারা সংগ্রহ করার সময় অবশ্যই সনদপত্র যাচাই করতে হবে।
- কলা গাছের পুষ্টি ঘাটতি যেন না হয়, সেজন্য সুষম সার প্রয়োগ করতে হবে।
৬. কলা গাছের পাতা দাগ রোগ
কলা পাতায় দাগ রোগ এক ধরনের ছত্রাকজনিত রোগ, যা কলা চাষে ব্যাপক ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। বাংলাদেশে এই রোগ মূলত আর্দ্র ও উষ্ণ পরিবেশে বেশি দেখা যায়। রোগটি কলার পাতা, কান্ড ও কখনো ফলের ওপরে আক্রমণ করতে পারে। পাতায় দেখা দাগগুলো সাধারণত বাদামী, কালচে বা হলুদচে হয়ে থাকে। এটি সময়মতো শনাক্ত ও প্রতিকার না করলে পুরো বাগানেই ব্যাপক ক্ষতি করতে পারে।
রোগের ধরন ও বিস্তার
পাতার দাগ রোগ সাধারণত ছত্রাক দ্বারা ছড়ায়। বৃষ্টির পানি, বাতাস ও পোকামাকড় এই রোগের বিস্তারে সহায়ক। রোগে আক্রান্ত পাতার অংশ শুকিয়ে যায়। ধীরে ধীরে দাগগুলো একত্রিত হয়ে বড় আকারে পরিণত হয়। ফলেও দাগ দেখা দিলে তা বাজারজাতের জন্য অযোগ্য হয়।
প্রাথমিক লক্ষণ
১. পাতায় ছোট ছোট হলদে বা বাদামী দাগ দেখা দেয়।
২. দাগগুলো ক্রমে বড় হয়ে কালো বা গাঢ় বাদামী হয়ে যায়।
৩. আক্রান্ত পাতা শুকিয়ে ঝুলে যায়।
৪. নতুন পাতা জন্মালে দাগ সংক্রমিতভাবে বের হয়।
৫. গাছের বৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হয়।
ক্ষতির পরিমাণ
পাতার দাগ রোগে আক্রান্ত গাছের সালোকসংশ্লেষণ কমে যায়। ফলে গাছ দুর্বল হয়ে পড়ে। ফলন ৩০-৬০% পর্যন্ত কমে যেতে পারে। বাজারজাতের উপযোগী ফল পাওয়া কমে যায়। দীর্ঘ সময় এ রোগ থাকলে নতুন চারা লাগানো হলেও আগের মতো ফলন পাওয়া যায় না।
রোগের কারণ
১. আর্দ্র ও ছায়াযুক্ত পরিবেশ।
২. মাটি ও বাতাসে ছত্রাকের উপস্থিতি।
৩. বৃষ্টির পানি বা সেচের পানি দ্বারা সংক্রমণ।
৪. আগাছা ও আক্রান্ত চারা ব্যবহার।
৫. বাগানে যন্ত্রপাতি জীবাণুমুক্ত না রাখা।
প্রতিকার ও প্রতিরোধ ব্যবস্থা
১. আক্রান্ত পাতা কেটে দূরে ফেলে দিতে হবে।
২. কপার অক্সিক্লোরাইড বা ম্যানকোজেব জাতীয় ছত্রাকনাশক ৭-১০ দিনে অন্তর স্প্রে করতে হবে।
৩. জমি পরিষ্কার ও আগাছামুক্ত রাখতে হবে।
৪. বাগানে পর্যাপ্ত বাতাস চলাচল নিশ্চিত করতে হবে।
৫. রোগমুক্ত চারা ব্যবহার করা উচিত।
৬. আক্রান্ত ফল দ্রুত অপসারণ করতে হবে।
৭. ভারসাম্যপূর্ণ সার প্রয়োগ করতে হবে, বিশেষ করে জৈব সার।
৮. বাগান পর্যবেক্ষণ করে রোগের প্রাথমিক লক্ষণ ধরতে হবে।
৯. সংক্রমিত অঞ্চলে পুনরায় চারা লাগানোর আগে জমি জীবাণুমুক্ত করতে হবে।
১০. কৃষি বিশেষজ্ঞের পরামর্শে সঠিক ছত্রাকনাশক ব্যবহার করা।
অতিরিক্ত করণীয়
- রোগপ্রবণ জমিতে সেচের পানি জমতে দেওয়া যাবে না।
- রোগ প্রতিরোধী কলার জাত চাষ করা ভালো।
- জৈব সার ব্যবহার করলে গাছের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়।
- প্রতি মৌসুমে বাগান পরিচ্ছন্ন রাখা জরুরি।
৭. কলা গাছের ফল পচা রোগ
কলা গাছের ফল পচা রোগ একটি ছত্রাকজনিত ও ব্যাকটেরিয়াজনিত সংক্রমণ দ্বারা সৃষ্ট রোগ। বাংলাদেশে বর্ষার সময় এবং আর্দ্র ও বাতাস কম প্রবাহিত এলাকায় এই রোগ বেশি দেখা যায়। রোগটি মূলত কলার ফলের উপর আক্রমণ করে। আক্রান্ত ফলের বাইরের ত্বক হলদে বা বাদামী দাগে ঢাকা পড়ে এবং ধীরে ধীরে পুরো ফল পচে যায়। কৃষকরা বাজারজাতের আগে এই রোগ শনাক্ত করতে না পারলে বড় ধরনের আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হন।
রোগের বিস্তার ও ধরন
ফল পচা রোগ বৃষ্টির পানি, বাতাস ও মাটি থেকে সহজেই ছড়ায়। পোকামাকড়ও ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়া বহনে সহায়ক। গাছের ফল যখন আর্দ্র থাকে বা গাছের কান্ড দুর্বল থাকে, তখন সংক্রমণ দ্রুত হয়। ধীরে ধীরে একাধিক ফল আক্রান্ত হয়ে পুরো ফলন নষ্ট করে দিতে পারে।
প্রাথমিক লক্ষণ
১. ফলের বাইরের অংশে ছোট ছোট দাগ দেখা যায়।
২. দাগগুলো ক্রমে বড় হয়ে গাঢ় বাদামী বা কালচে রঙ ধারণ করে।
৩. ফলের ভেতরের অংশ নরম হয়ে যায়।
৪. দুর্গন্ধযুক্ত তরল বের হতে পারে।
৫. আক্রান্ত ফল সময়মতো নষ্ট হয়ে যায় এবং গাছের বৃদ্ধি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
ক্ষতির পরিমাণ
ফল পচা রোগে আক্রান্ত কলা ফল বাজারজাতের উপযোগী থাকে না। ফলে কৃষক সম্পূর্ণ বা আংশিক অর্থনৈতিক ক্ষতির সম্মুখীন হন। জমিতে যদি ৩০-৫০% ফল আক্রান্ত হয়, তবে পুরো মৌসুমে লাভ অনেকাংশে কমে যায়। দীর্ঘমেয়াদি সংক্রমণ এলে পরবর্তী মৌসুমেও চারা সংক্রমিত হতে পারে।
রোগের কারণ
১. আর্দ্র ও ছায়াযুক্ত পরিবেশ।
২. মাটি ও বৃষ্টির পানি দ্বারা ছত্রাক বা ব্যাকটেরিয়ার বিস্তার।
৩. পোকামাকড়ের আক্রমণ।
৪. জমিতে আগের মৌসুমের রোগাক্রান্ত ফল বা চারা থাকলে।
৫. যথাযথ পরিচর্যা না থাকা।
প্রতিকার ও প্রতিরোধ ব্যবস্থা
১. আক্রান্ত ফল দ্রুত গাছ থেকে অপসারণ করতে হবে।
২. বাগান পরিষ্কার রাখা অত্যন্ত জরুরি।
৩. কপার অক্সিক্লোরাইড বা ম্যানকোজেব জাতীয় ছত্রাকনাশক নিয়মিত স্প্রে করতে হবে।
৪. জমিতে পর্যাপ্ত বাতাস ও সূর্যালোক পৌঁছানোর ব্যবস্থা রাখতে হবে।
৫. রোগমুক্ত ও টিস্যু কালচার চারা ব্যবহার করা আবশ্যক।
৬. বৃষ্টির সময় অতিরিক্ত পানি জমতে দেওয়া যাবে না।
৭. ভারসাম্যপূর্ণ সার প্রয়োগ করতে হবে, বিশেষ করে জৈব সার ব্যবহার করলে গাছের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়।
৮. পোকামাকড় দমন করতে হবে।
৯. রোগপ্রবণ অঞ্চলে পুনরায় চারা লাগানোর আগে জমি জীবাণুমুক্ত করতে হবে।
১০. কৃষি বিশেষজ্ঞের পরামর্শ অনুযায়ী কীটনাশক ও ছত্রাকনাশক প্রয়োগ করা।
অতিরিক্ত করণীয়
- ফল পচা রোগের প্রাথমিক লক্ষণ শনাক্ত করে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া।
- রোগপ্রবণ জমিতে পরবর্তী চারা লাগানোর আগে ছত্রাকনাশক প্রয়োগ।
- বাগানের পানি নিষ্কাশন নিশ্চিত করা।
- সংক্রমণ কমাতে বাগান নিয়মিত পর্যবেক্ষণ ও পরিচর্যা করা।
৮. কলা গাছের শিকড় পচা রোগ
কলা গাছের শিকড় পচা রোগ একটি মারাত্মক ছত্রাকজনিত সংক্রমণ, যা গাছের গোড়া বা মূলকাণ্ডে আক্রমণ করে। বাংলাদেশে আর্দ্র জমি এবং বর্ষার সময়ে এই রোগ বেশি দেখা যায়। রোগটি মূলত Fusarium oxysporum এবং Pythium spp. দ্বারা সৃষ্টি হয়। আক্রান্ত গাছের শিকড় নরম হয়ে যায়, কালচে বা বাদামী রঙ ধারণ করে এবং গাছ দ্রুত দুর্বল হয়ে পড়ে।
রোগ বিস্তার ও ধরন
শিকড় পচা রোগ মাটিতে দীর্ঘ সময় বেঁচে থাকে। আক্রান্ত জমিতে নতুন চারা লাগালে দ্রুত সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ে। পানি জমে থাকা, ভারী মাটি এবং পর্যাপ্ত বাতাস না থাকার কারণে ছত্রাক দ্রুত বৃদ্ধি পায়। পোকামাকড়ও রোগ ছড়াতে সাহায্য করে।
প্রাথমিক লক্ষণ
১. গাছ হঠাৎ নুয়ে পড়তে শুরু করে।
২. পাতা হলুদ হয়ে ধীরে ধীরে শুকিয়ে যায়।
৩. কান্ড দুর্বল হয়ে ভেঙে পড়ে।
৪. শিকড় নরম ও দুর্গন্ধযুক্ত হয়।
৫. নতুন পাতা স্বাভাবিকভাবে জন্মায় না।
ক্ষতির পরিমাণ
শিকড় পচা রোগে আক্রান্ত গাছ খুব দ্রুত মারা যায়। পুরো বাগান আক্রান্ত হলে ফলন প্রায় ৭০-৯০% কমে যায়। কৃষককে বড় ধরনের আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়তে হয়। দীর্ঘমেয়াদে জমি অসুস্থ হয়ে যায় এবং নতুন চারা লাগানো ঝুঁকিপূর্ণ হয়।
রোগের কারণ
১. জমিতে পানি জমে থাকা।
২. ভারী বা চাটাইযুক্ত মাটি।
৩. আগের মৌসুমের রোগাক্রান্ত গাছ বা শিকড় জমিতে থাকা।
৪. পোকামাকড়ের আঘাত।
৫. যথাযথ পরিচর্যার অভাব।
প্রতিকার ও প্রতিরোধ ব্যবস্থা
১. আক্রান্ত গাছ কেটে ফেলে পুড়িয়ে দিতে হবে।
২. রোগমুক্ত টিস্যু কালচার চারা ব্যবহার করতে হবে।
৩. জমি জীবাণুমুক্ত করতে হবে। প্রয়োজনে ফরমালিন বা জৈব ছত্রাকনাশক ব্যবহার।
৪. বাগানে পানি জমে না যাওয়ার ব্যবস্থা রাখতে হবে।
৫. ভারসাম্যপূর্ণ সার প্রয়োগ ও জৈব সার ব্যবহার করা উচিত।
৬. বাগান পর্যবেক্ষণ করে রোগের প্রাথমিক লক্ষণ শনাক্ত করতে হবে।
৭. নেমাটোড বা পোকামাকড় দমন করতে হবে।
৮. রোগপ্রবণ জমিতে পুনরায় চারা লাগানোর আগে মাটি পরিচ্ছন্ন করতে হবে।
৯. কৃষি বিশেষজ্ঞের পরামর্শ অনুযায়ী ছত্রাকনাশক প্রয়োগ।
১০. জমি আলাদা করতে হবে, যাতে আক্রান্ত অংশ থেকে সংক্রমণ না ছড়ায়।
উপসংহার (শিকড় পচা রোগ বিষয়ে)
শিকড় পচা রোগ দ্রুত গাছ নষ্ট করে দেয়। তবে রোগমুক্ত চারা ব্যবহার, জমি পরিচ্ছন্ন রাখা, পানি নিষ্কাশন নিশ্চিত করা ও নিয়মিত ছত্রাকনাশক প্রয়োগের মাধ্যমে এই রোগ নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব। সতর্কতা অবলম্বন করলে বাগানের ক্ষতি কমানো যায়।
৯. কলা গাছে পোকামাকড়ের আক্রমণ
কলা গাছে বিভিন্ন ধরনের পোকামাকড় আক্রমণ করে, যা গাছের বৃদ্ধি ও ফলনকে মারাত্মকভাবে প্রভাবিত করে। সাধারণ পোকামাকড়ের মধ্যে আছে এফিড, থ্রিপস, লিভারটি বগ, হোয়াইটফ্লাই ও নেমাটোডস। এই পোকামাকড় শুধু পাতা খায় না, তারা ভাইরাসও ছড়িয়ে দিতে পারে। তাই কৃষকের জন্য পোকামাকড় নিয়ন্ত্রণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
পোকামাকড়ের ধরন ও ক্ষতি
১. এফিড: পাতা ও কাণ্ডের রস শুষে গাছ দুর্বল করে। ভাইরাস ছড়ায়।
২. হোয়াইটফ্লাই: পাতা হলদে ও খসে যায়। ভাইরাস সংক্রমণ ঘটায়।
৩. থ্রিপস: পাতা খসানো ও ক্ষতচিহ্ন তৈরি করে।
৪. লিভারটি বগ: পাতা ও কাণ্ডে ক্ষতি করে।
৫. নেমাটোডস: শিকড় আক্রমণ করে, ফলে পানি ও খাদ্য পরিবহন বাধাগ্রস্ত হয়।
ক্ষতির পরিমাণ
পোকামাকড়ের আক্রমণে গাছের বৃদ্ধি কমে যায়। পাতা হলুদ হয়ে পড়ে ও ফলের মান খারাপ হয়। ফলন ৩০-৭০% কমে যেতে পারে। রোগ ও ভাইরাস সংক্রমণ বেড়ে যায়।
প্রতিকার ও প্রতিরোধ ব্যবস্থা
১. নিয়মিত বাগান পরিদর্শন।
২. এফিড ও হোয়াইটফ্লাই দমন করতে নিম তেল বা জৈব কীটনাশক ব্যবহার।
৩. নেমাটোড দমন করতে মাটি জীবাণুমুক্ত করা।
৪. রোগমুক্ত ও টিস্যু কালচার চারা ব্যবহার।
৫. আক্রান্ত অংশ কেটে পুড়িয়ে ফেলা।
৬. জৈব সার প্রয়োগে গাছের প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি।
৭. সংক্রমণ কমাতে বাগান পরিচ্ছন্ন রাখা।
৮. বাগানে পর্যাপ্ত বাতাস চলাচল নিশ্চিত করা।
৯. বৃষ্টির পানি জমতে না দেওয়ার ব্যবস্থা রাখা।
১০. কৃষি বিশেষজ্ঞের পরামর্শে সঠিক কীটনাশক ব্যবহার।
অতিরিক্ত করণীয়
- ঘন বাগান এড়ানো।
- বাগান পরিদর্শন করে প্রাথমিক লক্ষণ শনাক্ত করা।
- রোগপ্রবণ চারা বা গাছ আলাদা রাখা।
বহুল জিজ্ঞাসিত প্রশ্ন ও উত্তর সমূহ
কলা গাছের রোগ ও তার প্রতিকার সমূহ এই বিষয়ে আপনার মনে বেশ কয়েকটি প্রশ্ন উঁকি দিচ্ছে? তাহলে চলুন জেনে নেই সেই সকল প্রশ্ন ও উত্তরগুলো-
১.কলা গাছের রোগ প্রতিরোধের জন্য কী করা উচিত?
কলা গাছের রোগ প্রতিরোধে রোগমুক্ত টিস্যু কালচার চারা ব্যবহার করা, জমি পরিচ্ছন্ন রাখা, নিয়মিত পর্যবেক্ষণ এবং সঠিক ছত্রাকনাশক প্রয়োগ করা জরুরি। এছাড়া ভারসাম্যপূর্ণ সার প্রয়োগ এবং বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা রাখাও গুরুত্বপূর্ণ।
২.কলা গাছে পোকামাকড়ের আক্রমণ কিভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যায়?
পোকামাকড় নিয়ন্ত্রণে বাগান নিয়মিত পরিদর্শন, জৈব কীটনাশক ব্যবহার, রোগমুক্ত চারা লাগানো এবং বাগান পরিচ্ছন্ন রাখা প্রয়োজন। পোকামাকড় দমন করলে ভাইরাস সংক্রমণও কমে যায়।
উপসংহার
বাংলাদেশে কলা চাষে রোগ ও পোকামাকড়ের সমস্যা মারাত্মক। কলা গাছের বিভিন্ন রোগ যেমন সিগাটোকা, কান্ড পচা, ব্যাকটেরিয়াল উইল্ট, মোজাইক ভাইরাস, স্ট্রিক ভাইরাস, পাতা দাগ, ফল পচা, শিকড় পচা এবং পোকামাকড়ের আক্রমণ কৃষকের উৎপাদন ও আয়ের জন্য হুমকি। সঠিক পরিচর্যা, রোগমুক্ত চারা ব্যবহার, নিয়মিত বাগান পর্যবেক্ষণ, বাতাস ও পানি চলাচলের ব্যবস্থা, ভারসাম্যপূর্ণ সার প্রয়োগ এবং যথাযথ কীটনাশক ও ছত্রাকনাশক ব্যবহার করলেই এই ক্ষতি অনেকাংশে নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব। রোগ ও পোকামাকড় প্রতিরোধে সচেতনতা এবং কৃষি বিশেষজ্ঞের পরামর্শ গ্রহণ অপরিহার্য। সতর্কতা অবলম্বন করলে কলা চাষে উৎপাদন ও লাভ নিশ্চিত করা সম্ভব।