তলপেট ও অন্ডকোষ ব্যাথা?
বাংলাদেশে অনেক পুরুষ এমন এক বিব্রতকর সমস্যায় ভোগেন, যার নাম তলপেট ও অন্ডকোষের ব্যথা। অনেক সময় এই ব্যথা হালকা, আবার কখনও এটি এত তীব্র হয় যে হাঁটাচলা, বসা এমনকি ঘুমাতেও কষ্ট হয়। অনেকেই লজ্জা বা ভয় থেকে চিকিৎসকের কাছে যান না, ফলে সমস্যা আরও জটিল হয়ে পড়ে। কিন্তু এই ব্যথার পেছনে কারণ থাকতে পারে খুব সাধারণ বিষয় থেকে শুরু করে গুরুতর রোগ পর্যন্ত। তাই বিষয়টি অবহেলা না করে সঠিকভাবে বোঝা জরুরি।
তলপেট ও অন্ডকোষের ব্যথা শুধু এক জায়গার সমস্যা নয়, বরং এটি শরীরের অন্যান্য অংশেরও ইঙ্গিত দেয়। যেমন — কিডনি, মূত্রনালি, পেশি, বা প্রজনন অঙ্গের সংক্রমণ থেকেও এই ব্যথা হতে পারে। অনেক সময় গরম আবহাওয়া, দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে থাকা, বা আঁটসাঁট পোশাক পরাও এই ব্যথা বাড়িয়ে দেয়।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে পুরুষরা অনেক সময় মাঠে কাজ করেন, ভারী জিনিস তোলেন বা মোটরসাইকেল চালান দীর্ঘ সময় ধরে — এসব কারণে তলপেট ও অন্ডকোষে চাপ পড়ে এবং ব্যথা তৈরি হতে পারে। আবার, প্রস্রাবের ইনফেকশন, পাথর, বা হঠাৎ আঘাত লাগলেও এই ব্যথা দেখা দেয়।
সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো, অনেক সময় ব্যথা ধীরে ধীরে শুরু হয় এবং মানুষ ভাবেন এটি সামান্য ব্যথা। কিন্তু ধীরে ধীরে এটি জটিল রূপ নেয়, এমনকি অন্ডকোষ ফুলে যেতে পারে বা ব্যথা সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়তে পারে।
এই ধরনের ব্যথা কেবল শারীরিক নয়, মানসিক উদ্বেগও বাড়ায়। বিশেষ করে যারা বিবাহিত বা সন্তান নেওয়ার পরিকল্পনা করছেন, তাদের মধ্যে ভয় কাজ করে — “এই ব্যথা কি আমার প্রজনন ক্ষমতায় প্রভাব ফেলবে?” তাই সচেতনতা এবং সময়মতো চিকিৎসা নেওয়াই হতে পারে এই সমস্যার সবচেয়ে ভালো সমাধান।
এই ব্লগে আমরা জানব তলপেট ও অন্ডকোষে ব্যথার সম্ভাব্য কারণ, উপসর্গ, করণীয় ও প্রতিরোধের উপায়। পাশাপাশি, কোন ক্ষেত্রে চিকিৎসকের কাছে যাওয়া উচিত সেটাও বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হবে।
সুস্থ জীবনের জন্য প্রয়োজন নিজের শরীরের সংকেত বোঝা, কারণ প্রতিটি ব্যথাই কোনো না কোনো বার্তা দেয়। তাই আসুন, জানি — তলপেট ও অন্ডকোষ ব্যথার আসল কারণ কী এবং কীভাবে এ থেকে মুক্তি পাওয়া যায়।
তলপেট ও অন্ডকোষ ব্যাথা?

তলপেট ও অন্ডকোষের ব্যথা একসাথে হলে তা কোনো সাধারণ বিষয় নয়। এটি শরীরের ভেতরের নানা অঙ্গের সমস্যার ইঙ্গিত দিতে পারে — যেমন প্রস্রাবনালী, কিডনি, টেস্টিকল বা এমনকি হজমতন্ত্রের সমস্যা। ব্যথা কখনও হালকা, কখনও টান ধরার মতো বা জ্বালাপোড়ার অনুভূতি দিতে পারে। সময়মতো কারণ না বুঝলে এটি মারাত্মক জটিলতায় পরিণত হতে পারে। তাই এই ব্যথা হলে অবহেলা না করে কারণ খুঁজে বের করা জরুরি।বিস্তারিত আলোচনা করা হলো –
১. প্রস্রাবনালী সংক্রমণ (ইউরিনারি ট্র্যাক্ট ইনফেকশন)
প্রস্রাবনালী সংক্রমণ বা ইউরিনারি ট্র্যাক্ট ইনফেকশন (UTI) হলো এমন এক সাধারণ সমস্যা, যা পুরুষদের তলপেট ও অন্ডকোষে ব্যথার অন্যতম প্রধান কারণ। যদিও এটি নারীদের মধ্যে বেশি দেখা যায়, তবু বাংলাদেশের আবহাওয়া, পরিচ্ছন্নতার অভাব, গরমে ঘাম হওয়া, ও পর্যাপ্ত পানি না পান করার কারণে পুরুষদেরও এই সংক্রমণ প্রায়ই দেখা দেয়।
এই সংক্রমণ সাধারণত ব্যাকটেরিয়া দ্বারা হয়, বিশেষ করে ই. কোলাই নামের ব্যাকটেরিয়া, যা মলদ্বারের আশপাশ থেকে মূত্রনালিতে প্রবেশ করে। একবার সংক্রমণ শুরু হলে এটি ধীরে ধীরে প্রস্রাবনালী থেকে মূত্রথলি, এমনকি কিডনিতেও ছড়িয়ে পড়তে পারে। ফলে ব্যথা তলপেট থেকে অন্ডকোষ পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে এবং নিচের অংশে ভারীভাব, টান ধরার মতো অস্বস্তি অনুভূত হয়।
প্রস্রাবনালী সংক্রমণের প্রাথমিক লক্ষণগুলো হলো — প্রস্রাবের সময় জ্বালাপোড়া, ঘন ঘন প্রস্রাবের চাপ, প্রস্রাবের দুর্গন্ধ, ঘোলা বা লালচে রঙ, এবং তলপেটে টান লাগার অনুভূতি। অনেক সময় এই সংক্রমণের সঙ্গে অন্ডকোষেও হালকা ফুলে যাওয়া বা ব্যথা অনুভূত হতে পারে, বিশেষ করে সংক্রমণ নিচের দিকে নেমে এপিডিডাইমিস বা প্রোস্টেটে ছড়িয়ে গেলে।
বাংলাদেশে অনেক পুরুষ কর্মব্যস্ততার কারণে বা লজ্জার কারণে প্রস্রাব চেপে রাখেন, যা UTI হওয়ার অন্যতম কারণ। দীর্ঘ সময় প্রস্রাব চেপে রাখলে মূত্রনালীতে ব্যাকটেরিয়া জমে সংক্রমণ তৈরি করে। এছাড়া পর্যাপ্ত পানি না পান করলে প্রস্রাব ঘন হয়ে যায় এবং ব্যাকটেরিয়ার বৃদ্ধির জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরি হয়।
আরেকটি বড় কারণ হলো অস্বাস্থ্যকর টয়লেট ব্যবহার ও যৌনাঙ্গের পরিচ্ছন্নতা না রাখা। যারা দীর্ঘ সময় বাইরে কাজ করেন, পাবলিক টয়লেট ব্যবহার করেন, বা ঘেমে থাকা অবস্থায় কাপড় না বদলান — তাদের মধ্যে এই সমস্যা বেশি হয়।
যৌন সম্পর্কের মাধ্যমেও এই সংক্রমণ ছড়াতে পারে, বিশেষ করে যদি দুজনের মধ্যে পরিচ্ছন্নতার অভাব থাকে। তাই যৌন সম্পর্কের আগে ও পরে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকা এবং প্রয়োজন হলে প্রস্রাব করে নেওয়া ভালো অভ্যাস।
প্রস্রাবনালী সংক্রমণ হলে কিছু ক্ষেত্রে জ্বর, ঠান্ডা লাগা, বমি বমি ভাব বা কোমরের নিচে তীব্র ব্যথাও দেখা দিতে পারে। সংক্রমণ যদি কিডনিতে পৌঁছে যায়, তখন অবস্থাটি আরও জটিল হয় এবং হাসপাতালে ভর্তি পর্যন্ত হতে পারে।
চিকিৎসা দেরি করলে সংক্রমণ শুক্রনালিতে ছড়িয়ে অন্ডকোষে প্রদাহ সৃষ্টি করতে পারে, যাকে বলা হয় এপিডিডাইমাইটিস। তখন ব্যথা আরও তীব্র হয়, অন্ডকোষ ফুলে যায়, এবং বসা বা হাঁটাচলাও কষ্টকর হয়ে পড়ে।
UTI-এর চিকিৎসা সাধারণত অ্যান্টিবায়োটিক, পর্যাপ্ত পানি পান, ও বিশ্রামের মাধ্যমে করা হয়। তবে ওষুধ চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ীই খাওয়া উচিত, কারণ ভুল অ্যান্টিবায়োটিক বা অসম্পূর্ণ কোর্স করলে সংক্রমণ আবার ফিরে আসে।
২. কিডনিতে পাথর
কিডনিতে পাথর বা “কিডনি স্টোন” হলো এমন একটি সমস্যা, যা তলপেট ও অন্ডকোষে তীব্র ব্যথার অন্যতম সাধারণ কারণ। এই পাথর আসলে জমে থাকা খনিজ পদার্থ ও লবণের ফলাফল, যা ধীরে ধীরে কিডনি বা মূত্রনালিতে শক্ত দলা তৈরি করে। পাথরের আকার ছোট দানার মতোও হতে পারে, আবার কখনও বড় হয়ে পুরো নালি বন্ধ করে দেয়।
বাংলাদেশে কিডনিতে পাথর হওয়ার ঘটনা দ্রুত বাড়ছে। এর মূল কারণ হলো গরম আবহাওয়া, পর্যাপ্ত পানি না পান করা, অতিরিক্ত প্রোটিন, লবণ ও ফাস্টফুড খাওয়া। অনেক সময় মানুষ কাজের চাপে পানি কম পান করে, ফলে শরীরে পানি স্বল্পতা দেখা দেয়। এই অবস্থায় প্রস্রাবে থাকা খনিজ যেমন ক্যালসিয়াম, ইউরিক অ্যাসিড, ফসফেট ইত্যাদি জমে পাথর তৈরি করে।
কিডনিতে পাথর থাকলে প্রথম লক্ষণ হয় তীব্র ব্যথা, যা পিঠের এক পাশ থেকে শুরু হয়ে ধীরে ধীরে তলপেট হয়ে অন্ডকোষ পর্যন্ত ছড়িয়ে যায়। এই ব্যথাকে অনেক সময় “কোলিক পেইন” বলা হয় — হঠাৎ শুরু হয়, কিছুক্ষণ পর কমে যায়, আবার ফিরে আসে। ব্যথার সাথে অনেক সময় প্রস্রাবে জ্বালা, রক্ত মিশ্রিত প্রস্রাব, বমি বমি ভাব, ঘাম ও অস্বস্তি দেখা দেয়।
কিডনি পাথর শুধু ব্যথাই দেয় না, মূত্রনালিতে বাধা তৈরি করে প্রস্রাবের প্রবাহ বন্ধ করে দেয়। এতে কিডনি ফুলে যায় এবং রক্তে বর্জ্য পদার্থ জমে যায়, যা শরীরের জন্য বিপজ্জনক। কিছু ক্ষেত্রে জ্বর ও ঠান্ডা লাগাও হতে পারে, যা সংক্রমণের লক্ষণ।
অন্ডকোষের সাথে কিডনি পাথরের সম্পর্ক অনেকেই বোঝেন না। আসলে কিডনি থেকে বের হওয়া মূত্রনালি নিচের দিকে নেমে আসে, তাই পাথর যদি মূত্রনালির নিচের অংশে আটকে যায়, তাহলে ব্যথা অন্ডকোষ পর্যন্ত পৌঁছে যায়। এজন্য অনেক সময় মনে হয় অন্ডকোষেই ব্যথা হচ্ছে, অথচ আসল কারণ কিডনিতে।
বাংলাদেশে অনেকেই লোকজ উপায়ে পাথর নামানোর চেষ্টা করেন — যেমন লেবুর রস বা বিভিন্ন ভেষজ খাওয়া। যদিও ছোট পাথরের ক্ষেত্রে প্রচুর পানি পান করলে তা বের হয়ে যেতে পারে, কিন্তু বড় পাথরের ক্ষেত্রে এসব ঘরোয়া উপায় কার্যকর নয়। বরং সময় নষ্ট করে সমস্যা বাড়িয়ে তোলে।
চিকিৎসা নির্ভর করে পাথরের আকার, অবস্থান ও উপসর্গের উপর। ছোট পাথর (৫ মিমি পর্যন্ত) হলে ডাক্তার সাধারণত প্রচুর পানি পান, ব্যথানাশক ও কিছু ওষুধ দেন যাতে পাথর নিজে থেকেই বেরিয়ে আসে। তবে বড় পাথর হলে “ইউরেট্রোস্কপি”, “লিথোট্রিপসি” বা “পাথর ভাঙার লেজার চিকিৎসা” করতে হয়।
৩. টেস্টিকুলার টরশন (অন্ডকোষ মুচড়ে যাওয়া)
টেস্টিকুলার টরশন হলো এমন এক বিপজ্জনক অবস্থা, যা হলে অল্প সময়ের মধ্যেই অন্ডকোষে রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। এটি ঘটে যখন অন্ডকোষে থাকা শুক্রনালি (Spermatic cord) হঠাৎ মুচড়ে যায়, ফলে রক্ত সঞ্চালন ব্যাহত হয়। রক্ত চলাচল বন্ধ হলে অন্ডকোষে অক্সিজেন পৌঁছাতে পারে না এবং টিস্যু নষ্ট হতে শুরু করে। তাই এটি একটি চিকিৎসা জরুরি অবস্থা (medical emergency), যেখানে সময়ই সবকিছু নির্ধারণ করে দেয়।
এই সমস্যা সাধারণত কিশোর ও তরুণদের মধ্যে বেশি দেখা যায়, তবে যেকোনো বয়সে হতে পারে। বাংলাদেশে অনেক সময় স্কুল-কলেজ পড়ুয়া ছেলেদের মধ্যে হঠাৎ অন্ডকোষে তীব্র ব্যথা শুরু হলে তা টেস্টিকুলার টরশন হতে পারে, কিন্তু লজ্জা বা অজ্ঞানতার কারণে অনেকে বিষয়টি লুকিয়ে রাখে বা ঘরোয়া চিকিৎসায় সময় নষ্ট করে ফেলে।
ব্যথা সাধারণত হঠাৎ করে শুরু হয় — তীব্র, ছুরিকাঘাতের মতো এবং টান ধরা অনুভূতি দেয়। ব্যথা শুধু অন্ডকোষেই নয়, তলপেটের নিচের অংশে পর্যন্ত ছড়িয়ে যায়। অনেক সময় বমি বমি ভাব, বমি, মাথা ঘোরা, ও ঘামও হয়। আক্রান্ত অন্ডকোষ ফুলে যায়, লালচে বা কালচে হয়ে যায় এবং ছুঁলেই প্রচণ্ড ব্যথা লাগে।
টেস্টিকুলার টরশন হলে কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই রক্ত চলাচল সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায়। সাধারণত ৬ ঘণ্টার মধ্যে চিকিৎসা না পেলে অন্ডকোষ স্থায়ীভাবে নষ্ট হয়ে যেতে পারে। তাই এটি বুঝে দেরি না করে সরাসরি হাসপাতালে যাওয়া সবচেয়ে জরুরি।
বাংলাদেশে অনেক সময় বাবা-মা বা রোগী ভেবে নেন এটি হয়তো ঠান্ডা লাগা বা “পানি জমে গেছে” — ফলে ওষুধের দোকান থেকে ব্যথানাশক বা গরম সেঁক দেওয়া হয়। এতে কিছুটা আরাম মিললেও আসল সমস্যা থেকে যায়, এবং সময়ের অভাবে অন্ডকোষের কোষ মারা যেতে শুরু করে। ফলে পরবর্তীতে বন্ধ্যাত্ব বা স্থায়ী অন্ডকোষ ক্ষতির ঝুঁকি থেকে যায়।
টেস্টিকুলার টরশন সাধারণত দুটি কারণে হয় —
১. জন্মগতভাবে অন্ডকোষের অবস্থান বা গঠন একটু আলাদা হওয়া (যাকে বলা হয় “Bell-clapper deformity”)
২. হঠাৎ পজিশন পরিবর্তন, ঘুমের সময় মোচড়ানো, খেলাধুলা বা আঘাত লাগা
কখনও এটি এমনিতেও হতে পারে, কোনো কারণ ছাড়াই। তাই অন্ডকোষে হঠাৎ ব্যথা শুরু হলে তা কখনও অবহেলা করা উচিত নয়।
চিকিৎসায় সাধারণত অস্ত্রোপচার (surgery) করতে হয়। চিকিৎসক প্রথমে স্ক্রোটাম খুলে মুচড়ে যাওয়া শুক্রনালি সোজা করেন এবং রক্ত চলাচল স্বাভাবিক করেন। এরপর ভবিষ্যতে যেন আবার না ঘটে, সে জন্য দুটি অন্ডকোষকেই বিশেষভাবে স্থির করে দেওয়া হয় (orchiopexy)।
যদি সময়ের মধ্যে চিকিৎসা না হয়, তখন আক্রান্ত অন্ডকোষ সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে যায় এবং তা অপসারণ করতে হয়। তবে একটি অন্ডকোষ থাকলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পুরুষের প্রজনন ক্ষমতা বজায় থাকে, যদিও মানসিকভাবে এটি বড় আঘাত হয়ে দাঁড়ায়।
৪. এপিডিডাইমাইটিস (শুক্রনালিতে প্রদাহ)
এপিডিডাইমাইটিস হলো অন্ডকোষের পিছনে অবস্থিত ছোট নালিতে প্রদাহ বা সংক্রমণ হওয়া, যাকে চিকিৎসা ভাষায় বলা হয় epididymis। এই নালিটির কাজ হলো শুক্রাণু সংরক্ষণ ও পরিবহন করা। যখন এই অংশে ব্যাকটেরিয়া বা সংক্রমণ প্রবেশ করে, তখন প্রদাহ সৃষ্টি হয় এবং অন্ডকোষে ব্যথা, ফোলা ও অস্বস্তি দেখা দেয়। এই ব্যথা অনেক সময় তলপেট পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে, ফলে মনে হয় পুরো নিচের অংশেই টান ধরেছে বা ভারী হয়ে আছে।
বাংলাদেশে এই সমস্যা বেশ সাধারণ, বিশেষ করে তরুণ ও মধ্যবয়সী পুরুষদের মধ্যে। গরম আবহাওয়া, অপরিচ্ছন্নতা, টাইট পোশাক পরা, দীর্ঘ সময় বসে থাকা, বা প্রস্রাবের সংক্রমণ ঠিকমতো চিকিৎসা না করায় অনেক সময় এপিডিডাইমাইটিস হয়।
মূলত দুটি কারণে এই প্রদাহ দেখা দেয় —
১. ব্যাকটেরিয়াজনিত সংক্রমণ, বিশেষ করে E. coli বা Chlamydia trachomatis ব্যাকটেরিয়া।
২. যৌন সংক্রমণ (STD), যেমন গনোরিয়া বা ক্ল্যামিডিয়া।
সংক্রমণ সাধারণত প্রস্রাবনালী থেকে উপরে উঠে এসে এপিডিডাইমিসে ছড়িয়ে পড়ে। ফলে প্রথমে প্রস্রাবে হালকা জ্বালা বা ঘন ঘন প্রস্রাবের সমস্যা দেখা যায়, এরপর অন্ডকোষে ধীরে ধীরে ব্যথা বাড়তে থাকে। ব্যথা শুরুতে হালকা হলেও কয়েক ঘণ্টার মধ্যে তা টান ধরার মতো তীব্র হয়ে ওঠে।
প্রথম দিকে অন্ডকোষ স্পর্শ করলে ব্যথা লাগে না, কিন্তু প্রদাহ বাড়লে হালকা ছোঁয়াতেই প্রচণ্ড ব্যথা হয়। আক্রান্ত অন্ডকোষ ফুলে যায়, লালচে বা গরম হয়ে ওঠে। কখনও স্ক্রোটামের এক পাশে ভারীভাব বা নিচে টান লাগার অনুভূতি হয়। অনেক সময় জ্বর, ঠান্ডা লাগা, বা দুর্বলতাও দেখা দেয়।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে দেখা যায়, অনেক পুরুষ এই ব্যথাকে প্রথমে “ঠান্ডা লেগেছে” বা “হালকা আঘাত লেগেছে” ভেবে অবহেলা করেন। কেউ কেউ দোকানের ওষুধ খেয়ে বা গরম সেঁক দিয়ে আরাম পাওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু এতে সংক্রমণ সাময়িকভাবে কমলেও ভিতরের প্রদাহ থেকে যায়, যা পরে স্থায়ী সমস্যা তৈরি করে — যেমন প্রজনন নালিতে ব্লকেজ, শুক্রাণু উৎপাদনে সমস্যা, এমনকি বন্ধ্যাত্ব পর্যন্ত হতে পারে।
চিকিৎসার জন্য প্রথমে সঠিক নির্ণয় খুব জরুরি। সাধারণত আল্ট্রাসনোগ্রাফি ও প্রস্রাব পরীক্ষার মাধ্যমে বোঝা যায় প্রদাহ কতটা ছড়িয়েছে এবং অন্য কোনো জটিলতা আছে কি না। চিকিৎসক সাধারণত অ্যান্টিবায়োটিক, প্রদাহনাশক ও ব্যথানাশক ওষুধ দেন। সংক্রমণ যৌন রোগজনিত হলে, উভয় সঙ্গীকেই চিকিৎসা নিতে হয় যেন পুনরায় সংক্রমণ না ঘটে।
বিশ্রাম নেওয়া এই অবস্থায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অন্ডকোষকে সাপোর্ট দেওয়ার জন্য হালকা ফিটিংয়ের অন্তর্বাস পরা, আক্রান্ত স্থানে ঠান্ডা সেঁক দেওয়া, ও অতিরিক্ত হাঁটাচলা বা ভারী কাজ এড়িয়ে চলা উচিত।
৫. ইনগুইনাল হার্নিয়া (তলপেটের হার্নিয়া)
ইনগুইনাল হার্নিয়া হলো এমন একটি শারীরিক সমস্যা, যেখানে পেটের ভেতরের অংশ — যেমন অন্ত্র বা ফ্যাটি টিস্যু — নিচের দিকের দুর্বল জায়গা দিয়ে তলপেট বা অন্ডকোষের দিকে বেরিয়ে আসে। এটি সাধারণত তলপেটের এক পাশ বা উভয় পাশে দেখা দেয় এবং প্রথমে হালকা ফুলাভাব বা টান লাগার মতো অনুভূতি দিয়ে শুরু হয়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ব্যথা, ভারীভাব ও অস্বস্তি বাড়তে থাকে।
বাংলাদেশে এই সমস্যা বিশেষ করে পুরুষদের মধ্যে বেশি দেখা যায়, কারণ তাদের ইনগুইনাল ক্যানেল বা তলপেটের নালি তুলনামূলকভাবে দুর্বল হয়। অনেক সময় এই হার্নিয়া জন্মগতভাবে থাকে, আবার অনেকের ক্ষেত্রে বয়স, ভারী কাজ, বা অতিরিক্ত চাপের কারণে তৈরি হয়।
প্রাথমিকভাবে হার্নিয়া খুব ছোট থাকে এবং দাঁড়ালে বা কাশি দিলে ফুলে ওঠে, কিন্তু শুয়ে পড়লে বা বিশ্রাম নিলে সেটি আবার ভেতরে চলে যায়। এই অবস্থায় অনেকেই বিষয়টিকে তেমন গুরুত্ব দেন না। কিন্তু সময়ের সঙ্গে হার্নিয়ার আকার বাড়তে থাকে, এবং এক সময় সেটি স্থায়ীভাবে বাইরে বেরিয়ে আসে। তখন ব্যথা, পেটের টান, তলপেটে ভারী লাগা, এমনকি অন্ডকোষ পর্যন্ত ফোলা দেখা দিতে পারে।
ইনগুইনাল হার্নিয়ার প্রধান কারণগুলো হলো:
১. তলপেটের পেশি দুর্বল হয়ে যাওয়া, যা সাধারণত জন্মগত কারণ, বয়স, বা আঘাতের জন্য হয়।
২. ভারী জিনিস তোলা বা অতিরিক্ত চাপ দেওয়া, যেমন ভারোত্তোলন, কাঠের কাজ, রিকশা চালানো ইত্যাদি।
৩. বারবার কাশি বা কোষ্ঠকাঠিন্য, যা পেটে চাপ বাড়ায়।
৪. স্থূলতা বা মোটা হওয়া, ফলে পেটের অভ্যন্তরে অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি হয়।
৫. প্রস্টেট সমস্যা বা প্রস্রাবের কষ্ট, যার কারণে বারবার চাপ দিতে হয়।
বাংলাদেশের অনেক পুরুষ শ্রমজীবী কাজ করেন—যেমন মজুর, রিকশাচালক, কৃষক—যাদের প্রতিদিন ভারী জিনিস তুলতে হয়। তাই এদের মধ্যে হার্নিয়া বেশি দেখা যায়। অনেকে শুরুতে এটাকে শুধু “পেট ফুলে যাওয়া” ভেবে অবহেলা করেন, কিন্তু চিকিৎসা না নিলে এটি মারাত্মক হতে পারে।
৬. ভেরিকোসিল (অন্ডকোষের শিরা ফুলে যাওয়া)
ভেরিকোসিল হলো অন্ডকোষের ভিতরে থাকা শিরাগুলোর অস্বাভাবিক ফোলাভাব বা সম্প্রসারণ, যা অনেক সময় ধীরে ধীরে শুরু হয় এবং ব্যথা, ভারী অনুভূতি ও অন্ডকোষে ফোলা তৈরি করে। এটি মূলত শুক্রনালীর শিরায় রক্তের ভারসাম্য বিঘ্নিত হওয়ায় হয়। ভেরিকোসিলকে অনেক সময় “পুরুষদের ভেরিকোসিল” বা অন্ডকোষের ভেরিকোজ ভেইন বলেও বলা হয়।
বাংলাদেশে এটি সাধারণত বাম অন্ডকোষে বেশি দেখা যায়। এর কারণ হলো বাম শুক্রনালীর শিরা সরাসরি কিডনির শিরায় মিলে যায়, যেখানে রক্তের চাপ বেশি থাকে। ফলে শিরা সম্প্রসারণের ঝুঁকি বেশি।
ভেরিকোসিল সাধারণত ধীরে ধীরে শুরু হয়। প্রথমে লক্ষণগুলো হালকা — অন্ডকোষে হালকা ভারী অনুভূতি, ব্যথা বা টান ধরা। দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে থাকলে বা ব্যায়াম করলে ব্যথা বেড়ে যায়। অনেক সময় রোগীরা এটিকে উপেক্ষা করেন, কারণ ব্যথা তীব্র নয়, কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এটি অস্বস্তিকর হয়ে ওঠে।
মূলত দুই ধরনের ভেরিকোসিল দেখা যায় —
১. প্রাথমিক ভেরিকোসিল: জন্মগত কারণে শিরার ভেতরে ভলভের সমস্যা বা শিরার দুর্বলতা।
২. দ্বিতীয়িক ভেরিকোসিল: কিডনি বা পেটের ভেতরের সমস্যা, ভারী কাজ, বা অনিয়মিত জীবনযাপনের কারণে।
ভেরিকোসিল শুধুমাত্র ব্যথা নয়, বরং পুরুষের প্রজনন ক্ষমতায় প্রভাব ফেলতে পারে। দীর্ঘ সময় untreated ভেরিকোসিল থাকলে অন্ডকোষের তাপমাত্রা বেড়ে যায়, যা শুক্রাণুর উৎপাদন কমিয়ে দেয়। ফলে সন্তান ধারণে সমস্যা, শুক্রাণু সংখ্যা কমে যাওয়া বা গুণমান কমে যাওয়ার ঝুঁকি থাকে।
৭. প্রোস্টেটের সমস্যা (Prostate Issue)
প্রোস্টেট হলো পুরুষদের একটি ছোট গ্রন্থি, যা মূত্রনালীকে ঘিরে থাকে এবং শুক্রাণুর জন্য প্রয়োজনীয় স্রাব তৈরি করে। প্রোস্টেটের সমস্যার কারণে তলপেট ও অন্ডকোষে ব্যথা দেখা দিতে পারে, বিশেষ করে মধ্যবয়সী ও বয়স্ক পুরুষদের মধ্যে। বাংলাদেশে এই সমস্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে, কারণ খাদ্যাভ্যাস, দীর্ঘ সময় বসে থাকা ও পর্যাপ্ত পানি না পান করার কারণে প্রোস্টেটের স্বাভাবিক কার্যকারিতা প্রভাবিত হচ্ছে।
প্রোস্টেটের সমস্যার প্রধান তিনটি ধরন হলো:
১. বৃহত্তম প্রোস্টেট (BPH – Benign Prostatic Hyperplasia): বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে প্রোস্টেট বড় হয়ে যায়। এতে প্রস্রাবে চাপ বৃদ্ধি, ঘন ঘন প্রস্রাবের প্রয়োজন, তলপেটে ভারী অনুভূতি ও অল্প ব্যথা দেখা দেয়।
২. প্রোস্টেট প্রদাহ (Prostatitis): ব্যাকটেরিয়া বা সংক্রমণের কারণে প্রোস্টেটে প্রদাহ হয়। এটি হঠাৎ বা ধীরে ধীরে শুরু হতে পারে এবং তীব্র ব্যথা, জ্বালা, ঘন ঘন প্রস্রাব, অন্ডকোষ ও তলপেটে টান ধরার অনুভূতি সৃষ্টি করে।
৩. প্রোস্টেট ক্যান্সার: তুলনামূলকভাবে কম দেখা যায়, তবে বয়স বাড়লে ঝুঁকি বাড়ে। প্রাথমিকভাবে এটি স্পষ্ট লক্ষণ দেয় না, তবে অন্ডকোষ ও তলপেটে অস্বস্তি, ঘন ঘন প্রস্রাব ও রাতে বারবার প্রস্রাবের সমস্যা দেখা দিতে পারে।
প্রোস্টেটের সমস্যা তলপেট ও অন্ডকোষে ব্যথার অন্যতম কারণ। প্রোস্টেটের স্ফীতি বা প্রদাহ মূত্রনালীকে চাপ দেয়, ফলে প্রস্রাবের সময় ব্যথা, ঝালাভাব, এবং কখনও হালকা রক্ত আসতে পারে। দীর্ঘ সময় untreated থাকলে কিডনি ও মূত্রথলিও ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
বাংলাদেশে পুরুষরা প্রায়ই লজ্জা বা অজ্ঞানতার কারণে প্রোস্টেটের সমস্যার লক্ষণ উপেক্ষা করেন। অনেকেই মনে করেন এটি শুধু বয়সজনিত সমস্যা বা সামান্য ব্যথা। কিন্তু চিকিৎসা না করলে সমস্যা বাড়তে থাকে, এবং প্রজনন ও প্রস্রাবের উপর মারাত্মক প্রভাব ফেলতে পারে।
চিকিৎসা নির্ভর করে সমস্যার ধরন ও তীব্রতার উপর। বৃহত্তম প্রোস্টেট হলে ওষুধের মাধ্যমে প্রস্রাব সহজ করা যায়। প্রোস্টেট প্রদাহ হলে অ্যান্টিবায়োটিক ও প্রদাহনাশক প্রয়োজন হয়। যেখানে উপশির্ষের মতো সমস্যা গুরুতর, সেখানে সার্জারি বা অন্যান্য চিকিৎসা পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়।
৮. মানসিক চাপ ও স্ট্রেস
মানসিক চাপ ও স্ট্রেস হলো আধুনিক জীবনের একটি সাধারণ সমস্যা, যা সরাসরি বা পরোক্ষভাবে তলপেট ও অন্ডকোষের ব্যথার সঙ্গে সম্পর্কিত হতে পারে। বাংলাদেশে দ্রুত জীবনযাত্রা, দীর্ঘ কাজের সময়, প্রতিযোগিতা, আর্থিক চাপ ও দৈনন্দিন সমস্যার কারণে পুরুষদের মধ্যে মানসিক চাপ বেড়ে গেছে। এটি শারীরিক স্বাস্থ্যের পাশাপাশি অন্ডকোষের স্বাভাবিক কার্যকারিতার ওপরও প্রভাব ফেলতে পারে।
মানসিক চাপ দীর্ঘ সময় ধরে থাকলে শরীরে হরমোনের ভারসাম্য বিপর্যস্ত হয়। বিশেষ করে কর্টিসল ও অ্যাড্রেনালিনের মাত্রা বাড়ে, যা রক্তচাপ ও রক্তপ্রবাহে পরিবর্তন আনে। অন্ডকোষে রক্তপ্রবাহ কমে গেলে ব্যথা, ভারী অনুভূতি বা অস্বস্তি তৈরি হতে পারে।
স্ট্রেসের কারণে অনেক পুরুষ ঘুম কম পান, ভুল খাদ্যাভ্যাস গ্রহণ করেন, বা পর্যাপ্ত পানি পান করেন না। এটি প্রস্রাবনালী ও প্রোস্টেটের সমস্যা বাড়িয়ে দিতে পারে, যার ফলে তলপেট ও অন্ডকোষে ব্যথা আরও প্রকট হয়। এছাড়া স্ট্রেস শরীরের প্রদাহজনিত প্রতিক্রিয়া বৃদ্ধি করে, যা ইতিমধ্যেই চলমান ইউটিআই, ভেরিকোসিল বা প্রোস্টেট সমস্যাকে আরও তীব্র করে।
মানসিক চাপ এবং অন্ডকোষের ব্যথার সম্পর্কের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো পেশির টান ও সংকোচন। দীর্ঘ সময় মানসিক চাপের কারণে শরীরের পেশি টান ধরে রাখে, বিশেষ করে তলপেট ও পায়ের পেশি। এটি অন্ডকোষ ও তলপেটে ব্যথা বা ভারী অনুভূতি তৈরি করতে পারে।
৯. পেশি ও নড়াচড়ার সমস্যা
তলপেট ও অন্ডকোষে ব্যথার একটি সাধারণ কারণ হলো পেশি ও নড়াচড়ার সমস্যা। বাংলাদেশের পুরুষদের মধ্যে যারা ভারী কাজ করেন, যেমন কৃষি, নির্মাণ, রিকশা বা দৈনিক শারীরিক পরিশ্রম বেশি, তাদের তলপেট ও কোমরের পেশিতে চাপ পড়ে। পেশির অতিরিক্ত টান বা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া অন্ডকোষের পাশের অঞ্চলেও ব্যথা ছড়িয়ে দিতে পারে।
পেশির টান অনেক সময় হঠাৎ ঘটে, যেমন ভারী কিছু তুললে বা খেলাধুলার সময়। আবার ধীরে ধীরে ব্যথা বৃদ্ধি পায়, যখন পেশি দীর্ঘ সময় ধরে অতিরিক্ত চাপের মুখোমুখি হয়। এই ধরনের ব্যথা সাধারণত শারীরিক কসরত, বসা বা হাঁটার সময় তীব্র হয়, আর বিশ্রাম নিলে কিছুটা কমে আসে।
বাংলাদেশে দীর্ঘ সময় কম্পিউটারের সামনে বসে কাজ করা, স্কুল-কলেজ পড়ুয়া ছাত্রদের ভারী ব্যাগ বহন, বা অফিসে দীর্ঘ সময় বসে থাকা—এসবও পেশির টান ও অন্ডকোষের ব্যথা বাড়াতে পারে। পেশি ও নড়াচড়ার সমস্যা সাধারণত স্থায়ী নয়, তবে সঠিক বিশ্রাম, হালকা ব্যায়াম, হালকা গরম সেঁক এবং পেশি স্ট্রেচিং করলে দ্রুত আরাম পাওয়া যায়।
১০. অন্যান্য বিরল কারণ
কিছু ক্ষেত্রে তলপেট ও অন্ডকোষে ব্যথা অত্যন্ত বিরল শারীরিক সমস্যার কারণে হতে পারে। এর মধ্যে রয়েছে:
- শুক্রনালীর থ্রম্বোসিস (Spermatic vein বা artery-তে রক্ত জমে যাওয়া)
- কিডনি বা ইউরিনারি ট্র্যাক্টের অস্বাভাবিক গঠন
- ক্যান্সার (যেমন অন্ডকোষ বা প্রোস্টেট ক্যান্সার)
- অটোইমিউন বা প্রদাহজনিত রোগ
এই ধরনের সমস্যাগুলো সাধারণত খুবই বিরল, কিন্তু ব্যথা দীর্ঘমেয়াদি, তীব্র এবং অন্যান্য উপসর্গ যেমন ফোলা, রক্ত দেখা, জ্বর বা প্রস্রাবের অসুবিধা সঙ্গে থাকলে সন্দেহ করা হয়। বাংলাদেশে চিকিৎসকরা সাধারণত আল্ট্রাসনোগ্রাফি, ইউরোলজিকাল পরীক্ষা এবং প্রয়োজনে ল্যাব টেস্টের মাধ্যমে সঠিক কারণ নির্ণয় করেন।
সতর্কতা:
যদি সাধারণ ইউটিআই, পেশি টান বা হার্নিয়া উপশিরোনামের ব্যথা নয়, বরং হঠাৎ বা তীব্র ব্যথা দেখা দেয়, দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া গুরুত্বপূর্ণ। কারণ অবহেলা করলে স্থায়ী ক্ষতি বা জটিলতা দেখা দিতে পারে।
অন্ডকোষে ব্যথা হয় কেন?

অন্ডকোষে ব্যথা বা অস্বস্তি পুরুষদের মধ্যে একটি সাধারণ সমস্যা, যা হঠাৎ বা ধীরে ধীরে শুরু হতে পারে। বাংলাদেশে আবহাওয়া, জীবনযাত্রা ও খাদ্যাভ্যাসের কারণে এই সমস্যা অনেকের মধ্যে দেখা যায়। অন্ডকোষে ব্যথা শুধু শারীরিক সমস্যা নয়, কখনও মানসিক চাপ বা জীবনধারার ফলেও হতে পারে।
মূলত ব্যথার কারণগুলোকে কয়েকটি ভাগে বোঝা যায়। প্রথমত, সংক্রমণ বা প্রদাহ, যেমন ইউরিনারি ট্র্যাক্ট ইনফেকশন (UTI) বা এপিডিডাইমাইটিস। যখন মূত্রনালী বা শুক্রনালি সংক্রমিত হয়, তখন ব্যাকটেরিয়া অন্ডকোষে প্রদাহ সৃষ্টি করে, ফলে ব্যথা ও ফোলা দেখা দেয়।
দ্বিতীয়ত, টেস্টিকুলার টরশন বা অন্ডকোষ মুচড়ে যাওয়া। এটি হঠাৎ ঘটে এবং রক্ত চলাচল বন্ধ হওয়ায় অন্ডকোষে তীব্র ব্যথা হয়। দ্রুত চিকিৎসা না করলে স্থায়ী ক্ষতি বা অপসারণের প্রয়োজন হতে পারে।
তৃতীয়ত, কিডনিতে পাথর বা প্রোস্টেট সমস্যা। কিডনিতে পাথর মূত্রনালিতে আটকে গেলে ব্যথা অন্ডকোষ পর্যন্ত ছড়িয়ে যায়। প্রোস্টেট প্রদাহ বা বড় হওয়া মূত্রনালীকে চাপ দেয়, ফলে তলপেট ও অন্ডকোষে ব্যথা দেখা দেয়।
চতুর্থত, ভেরিকোসিল বা শুক্রনালীর শিরা ফুলে যাওয়া। এটি ধীরে ধীরে শুরু হয় এবং অন্ডকোষে ভারী অনুভূতি, টান বা হালকা ব্যথা তৈরি করে। দীর্ঘমেয়াদে প্রজনন ক্ষমতাও প্রভাবিত হতে পারে।
পঞ্চমত, ইনগুইনাল হার্নিয়া বা তলপেটের হার্নিয়া। পেটের ভেতরের অংশ দুর্বল জায়গা দিয়ে বের হয়ে অন্ডকোষ পর্যন্ত যেতে পারে। প্রথমে হালকা ফোলা বা টান অনুভূত হয়, পরে ব্যথা বেড়ে যায়।
ষষ্ঠত, পেশি বা নড়াচড়ার সমস্যা। ভারী কাজ, দীর্ঘ সময় বসে থাকা, বা হঠাৎ শরীরচলন পেশিতে টান সৃষ্টি করে, যা অন্ডকোষের পাশের অঞ্চলেও ব্যথা ছড়িয়ে দেয়।
সপ্তমত, মানসিক চাপ ও স্ট্রেস। দীর্ঘমেয়াদী মানসিক চাপ শরীরে হরমোনের ভারসাম্য পরিবর্তন করে, রক্তপ্রবাহ কমিয়ে দেয় এবং পেশির টান বাড়ায়, ফলে অন্ডকোষে ব্যথা দেখা দেয়।
অষ্টমত, অন্যান্য বিরল কারণ, যেমন থ্রম্বোসিস, ক্যান্সার বা অটোইমিউন সমস্যা। এইসব ক্ষেত্রে ব্যথা তীব্র, দীর্ঘস্থায়ী এবং অন্যান্য উপসর্গ যেমন ফোলা, জ্বর বা রক্তের উপস্থিতি থাকে।
বাংলাদেশে পুরুষরা অনেক সময় অল্প ব্যথা বা ভারী অনুভূতিকে উপেক্ষা করেন। কিন্তু সময়মতো চিকিৎসা না করলে সমস্যাগুলো জটিল হতে পারে। বিশেষ করে টেস্টিকুলার টরশন, ইনফেকশন বা হার্নিয়ার ক্ষেত্রে দ্রুত চিকিৎসা নেওয়া জরুরি।
চিকিৎসা নির্ভর করে ব্যথার প্রকৃতি ও কারণের ওপর। সংক্রমণে অ্যান্টিবায়োটিক, প্রদাহনাশক ও বিশ্রাম প্রয়োজন। টরশন বা হার্নিয়াতে অস্ত্রোপচার দরকার হয়। কিডনি পাথর বা প্রোস্টেট সমস্যায় নির্দিষ্ট চিকিৎসা প্রয়োজন।
প্রতিরোধমূলক কিছু উপায় হলো — যথেষ্ট পানি পান করা, স্বাস্থ্যকর জীবনধারা, ভারী কাজের সময় সতর্ক থাকা, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা এবং সময়মতো চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া।
সারসংক্ষেপে, অন্ডকোষে ব্যথা হতে পারে সংক্রমণ, টরশন, কিডনি বা প্রোস্টেট সমস্যা, শিরা ফুলে যাওয়া, হার্নিয়া, পেশির টান, মানসিক চাপ বা বিরল রোগজনিত কারণে। প্রাথমিক পর্যায়ে সচেতনতা, সঠিক জীবনযাপন ও চিকিৎসা এই ব্যথা কমাতে সাহায্য করে।
বহুল জিজ্ঞাসিত প্রশ্ন ও উত্তর সমূহ
তলপেট ও অন্ডকোষ ব্যাথা? এই বিষয়ে আপনার মনে বেশ কয়েকটি প্রশ্ন উঁকি দিচ্ছে? তাহলে চলুন জেনে নেই সেই সকল প্রশ্ন ও উত্তরগুলো-
অন্ডকোষে হঠাৎ ব্যথা হলে কি করা উচিত?
হঠাৎ বা তীব্র ব্যথা দেখা দিলে অবিলম্বে চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে। বিশেষ করে যদি ব্যথা সঙ্গে ফোলা, লালচে ভাব, জ্বর বা বমি থাকে, তাহলে এটি টেস্টিকুলার টরশন বা সংক্রমণ হতে পারে, যা দ্রুত চিকিৎসা না পেলে স্থায়ী ক্ষতি করতে পারে।
তলপেট ও অন্ডকোষের ব্যথা কমানোর ঘরোয়া পদ্ধতি কি আছে?
হালকা ব্যথা বা অস্বস্তির জন্য বিশ্রাম, হালকা গরম সেঁক, পর্যাপ্ত পানি পান এবং হালকা ব্যায়াম কার্যকর হতে পারে। তবে দীর্ঘস্থায়ী বা তীব্র ব্যথা থাকলে ঘরোয়া চিকিৎসায় ভরসা না করে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া সবচেয়ে নিরাপদ।
উপসংহার
তলপেট ও অন্ডকোষে ব্যথা পুরুষদের মধ্যে একটি সাধারণ, কিন্তু অনেক সময় মারাত্মক সমস্যা। বাংলাদেশে খাদ্যাভ্যাস, জীবনধারা, হঠাৎ শারীরিক চাপ, সংক্রমণ ও মানসিক চাপের কারণে এটি বেড়ে গেছে। ব্যথার কারণগুলো বিভিন্ন ধরনের — যেমন কিডনিতে পাথর, টেস্টিকুলার টরশন, এপিডিডাইমাইটিস, প্রোস্টেটের সমস্যা, ভেরিকোসিল, হার্নিয়া, পেশি টান, মানসিক চাপ বা বিরল রোগ।
প্রাথমিক পর্যায়ে হালকা ব্যথা ও অস্বস্তি অনেক সময় উপেক্ষা করা হয়। কিন্তু সময়মতো চিকিৎসা না নিলে সমস্যা জটিল হয়ে যেতে পারে, যেমন স্থায়ী অন্ডকোষ ক্ষতি, প্রজনন ক্ষমতার হ্রাস বা কিডনির জটিলতা। সঠিক পরীক্ষা, নির্ণয় এবং চিকিৎসা নেওয়া অত্যন্ত জরুরি।
প্রতিরোধমূলক কিছু পদক্ষেপ যথেষ্ট কার্যকর — যথেষ্ট পানি পান করা, স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস, ভারী কাজের সময় সতর্ক থাকা, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা, মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণ ও নিয়মিত ফলোআপ। সচেতনতা, দ্রুত চিকিৎসা এবং জীবনযাত্রায় পরিবর্তন এই ব্যথা কমাতে ও ভবিষ্যতে পুনরাবৃত্তি রোধ করতে সাহায্য করে।
