কিডনিতে পাথর হলে কি খাওয়া যাবে না?
বাংলাদেশে কিডনিতে পাথর একটি সাধারণ ও ক্রমবর্ধমান স্বাস্থ্যসমস্যা। বিশেষ করে গরম আবহাওয়া, পর্যাপ্ত পানি না খাওয়া, অতিরিক্ত লবণ ও প্রোটিনযুক্ত খাবার গ্রহণ এবং অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপনের কারণে অনেকেই এই সমস্যায় ভোগেন। কিডনি আমাদের শরীরের একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ যা রক্ত পরিশোধন করে, শরীরের বর্জ্য পদার্থ ও অতিরিক্ত পানি প্রস্রাবের মাধ্যমে বের করে দেয়। কিন্তু যখন এই বর্জ্য পদার্থ ও খনিজ উপাদান জমে যায়, তখন ধীরে ধীরে ছোট ছোট দানা তৈরি হয়, যাকে আমরা কিডনির পাথর বলি।
এই পাথর কখনো ছোট আকারে থেকেই শরীর থেকে বের হয়ে যায়, আবার কখনো বড় হয়ে প্রস্রাবের পথ বন্ধ করে দেয়, ফলে তীব্র ব্যথা, জ্বালাপোড়া, বমি এবং প্রস্রাবে রক্ত দেখা দেয়। বাংলাদেশে বিশেষ করে যারা পর্যাপ্ত পানি পান করেন না, অতিরিক্ত মাংস বা লবণ খান, তাদের মধ্যে কিডনিতে পাথর হওয়ার ঝুঁকি বেশি দেখা যায়।
প্রাথমিক পর্যায়ে সচেতনতা, খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন, এবং ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ খেলে এই সমস্যা নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব। তাই আজ আমরা জানব — কিডনিতে পাথর হলে কোন ওষুধ খেতে হয়, কোন খাবার এড়িয়ে চলা উচিত এবং কেন এই সমস্যা হয়।
কিডনিতে পাথর হলে কি ওষুধ খেতে হবে?

কিডনিতে পাথর হলে চিকিৎসা নির্ভর করে পাথরের আকার, অবস্থান ও উপসর্গের উপর। ছোট আকারের পাথর (৫ মিমি পর্যন্ত) অনেক সময় ওষুধ খেয়েই বের হয়ে যায়। এ ক্ষেত্রে ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী কিছু ওষুধ খাওয়া হয়, যা পাথর গলাতে বা প্রস্রাবের মাধ্যমে বের করতে সাহায্য করে।
বাংলাদেশে সাধারণত ইউরোলজিস্ট বা কিডনি বিশেষজ্ঞরা কিছু নির্দিষ্ট ওষুধ দেন যেমন—
- Tamsulosin (টামসুলোসিন): এটি মূত্রনালির পেশি শিথিল করে, ফলে পাথর সহজে নিচে নামতে পারে।
- Potassium Citrate বা Sodium Bicarbonate: এই ওষুধ প্রস্রাবের অম্লতা কমিয়ে দেয়, ফলে ইউরিক অ্যাসিড বা ক্যালসিয়াম অক্সালেট পাথর গলতে সাহায্য পায়।
- Pain Relievers (যেমন Ibuprofen বা Diclofenac): পাথরের ব্যথা অনেক তীব্র হয়, তাই ব্যথা কমাতে এসব ওষুধ দেয়া হয়।
- Antibiotic: যদি পাথরের সাথে সংক্রমণ থাকে, তখন ডাক্তারের নির্দেশে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করা হয়।
তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো নিজে থেকে কোনো ওষুধ খাওয়া নয়। কারণ, অনেক সময় পাথরের ধরন ও অবস্থান বুঝে ওষুধ বেছে নিতে হয়। ভুল ওষুধ খেলে পাথর আরও বড় হতে পারে বা কিডনি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী পর্যাপ্ত পানি পান করা, প্রতিদিন কমপক্ষে ২.৫ থেকে ৩ লিটার পানি খাওয়া, এবং প্রস্রাব পরিষ্কার রাখাই সবচেয়ে কার্যকর পদক্ষেপ।
কিডনিতে পাথর হলে কি খাওয়া যাবে না?

কিডনিতে পাথর হলে খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন আনা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ভুল খাদ্যাভ্যাসই অনেক সময় পাথর তৈরির মূল কারণ হয়ে দাঁড়ায়। নিচে ১০টি খাবার দেওয়া হলো যা কিডনিতে পাথর থাকলে একেবারে এড়িয়ে চলা উচিত —
🧂 ১. অতিরিক্ত লবণযুক্ত খাবার
অতিরিক্ত লবণ গ্রহণ কিডনিতে পাথর হওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ। লবণে থাকা সোডিয়াম (Sodium) শরীরের খনিজ ভারসাম্য নষ্ট করে এবং কিডনিকে অতিরিক্ত কাজ করতে বাধ্য করে। যখন শরীরে সোডিয়ামের মাত্রা বেড়ে যায়, তখন কিডনি প্রস্রাবের মাধ্যমে ক্যালসিয়াম বের করে দিতে পারে না। ফলে অতিরিক্ত ক্যালসিয়াম প্রস্রাবে জমে থেকে যায়, যা ধীরে ধীরে ক্যালসিয়াম অক্সালেট পাথর তৈরি করে।
বাংলাদেশের মানুষের খাদ্যাভ্যাসে লবণের ব্যবহার তুলনামূলক বেশি দেখা যায়। যেমন — ভর্তা, ভাজা, আচার, শুকনো মাছ, চিপস, সস, ঝালমুড়ি ইত্যাদি খাবারে প্রচুর লবণ ব্যবহার করা হয়। অনেকেই আবার ভাত খাওয়ার সময় আলাদা করে লবণ মিশিয়ে খান, যা একদমই কিডনি-বান্ধব নয়।
ডাক্তারদের মতে, একজন সুস্থ প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তির দৈনিক লবণ গ্রহণের পরিমাণ হওয়া উচিত সর্বোচ্চ ৫ গ্রাম (এক চা চামচ)। কিন্তু আমরা গড়ে তার দ্বিগুণ বা তিনগুণ লবণ খাই, যা কিডনির উপর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলে। অতিরিক্ত লবণ শুধু কিডনিতে পাথর তৈরি করে না, বরং রক্তচাপ বৃদ্ধি, পানি জমা, ও কিডনির ফিল্টার নষ্টের ঝুঁকিও বাড়ায়।
এছাড়া বাজারে পাওয়া প্রক্রিয়াজাত খাবার (processed food) যেমন ইনস্ট্যান্ট নুডলস, সস, ক্যানজাত স্যুপ, প্যাকেট চিপস ও ফাস্টফুডে লুকানো লবণের পরিমাণ অনেক বেশি থাকে। এই ধরনের খাবার নিয়মিত খেলে শরীরের সোডিয়াম লেভেল অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যায়, যা কিডনির স্বাভাবিক কার্যক্রমে বাধা সৃষ্টি করে।
গ্রামীণ অঞ্চলে যারা শুকনো মাছ বা নোনতা মাছ নিয়মিত খান, তাদের ক্ষেত্রেও একই সমস্যা দেখা যায়। কারণ, এসব খাবারে সংরক্ষণের জন্য অতিরিক্ত লবণ ব্যবহার করা হয়। এতে শরীরে পানি জমে, প্রস্রাব ঘন হয়ে যায়, এবং কিডনি সহজে বর্জ্য বের করতে পারে না।
অতিরিক্ত লবণ কমানোর সবচেয়ে সহজ উপায় হলো —
- রান্নায় লবণের পরিমাণ কমানো।
- টেবিল লবণ (ভাত খাওয়ার সময় আলাদা লবণ) একেবারে বাদ দেওয়া।
- প্রক্রিয়াজাত খাবার এড়িয়ে চলা।
- পর্যাপ্ত পানি পান করা, যাতে সোডিয়াম প্রস্রাবের মাধ্যমে বের হয়ে যায়।
বাংলাদেশের আবহাওয়ায় ঘাম বেশি হয় বলে অনেকেই মনে করেন বেশি লবণ খাওয়া দরকার — কিন্তু এটি ভুল ধারণা। বরং, অতিরিক্ত লবণ শরীরের পানি শোষণ করে নেয় এবং কিডনিকে ক্লান্ত করে তোলে।
সুতরাং, কিডনিতে পাথর হলে বা পাথরের ঝুঁকি থাকলে লবণ নিয়ন্ত্রণই সবচেয়ে কার্যকর প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা। নিয়মিত কম লবণ খেলে শুধু কিডনি নয়, হার্ট, রক্তচাপ এবং সার্বিক স্বাস্থ্যেরও উন্নতি হয়।
🍖 ২. লাল মাংস
কিডনিতে পাথর হওয়ার অন্যতম কারণ হলো শরীরে অতিরিক্ত প্রোটিন ও ইউরিক অ্যাসিড জমে যাওয়া, আর এই দুই উপাদানের প্রধান উৎস হলো লাল মাংস। গরু, খাসি, ভেড়া বা মহিষের মাংসে প্রচুর পরিমাণে পুরিন (Purine) নামের যৌগ থাকে, যা শরীরে ভেঙে ইউরিক অ্যাসিড তৈরি করে। যখন ইউরিক অ্যাসিডের মাত্রা বেড়ে যায়, তখন তা প্রস্রাবের মাধ্যমে বের হতে না পেরে কিডনিতে জমে গিয়ে ইউরিক অ্যাসিড পাথর তৈরি করে।
বাংলাদেশে লাল মাংস খাওয়ার প্রবণতা বেশ বেশি — বিশেষ করে ঈদ-উল-আযহা বা উৎসবের সময় অনেকেই টানা কয়েকদিন মাংস খেয়ে থাকেন। এমনকি অনেকেই প্রতিদিনের খাবার তালিকায় গরু বা খাসির মাংস রাখেন, যা কিডনির জন্য বড় ক্ষতির কারণ হতে পারে।
ডাক্তারদের মতে, অতিরিক্ত লাল মাংস খেলে শুধু কিডনি নয়, রক্তচাপ, কোলেস্টেরল, এবং হার্টের সমস্যাও বাড়ে। মাংসে থাকা স্যাচুরেটেড ফ্যাট কিডনির ফিল্টারিং সিস্টেমে চাপ ফেলে এবং কিডনির রক্তনালী ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। তাছাড়া বেশি মাংস খেলে শরীরে প্রস্রাবের অম্লতা (Acidity) বেড়ে যায়, যা পাথর গঠনের উপযোগী পরিবেশ তৈরি করে।
আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো — অনেকেই মনে করেন “প্রোটিন শরীরের জন্য ভালো, তাই মাংস যত বেশি খাওয়া যায় তত ভালো”, কিন্তু কিডনি রোগীদের ক্ষেত্রে এটি বিপরীত প্রভাব ফেলে। কিডনি যখন অতিরিক্ত প্রোটিন ভাঙতে চেষ্টা করে, তখন তার উপর চাপ পড়ে এবং ধীরে ধীরে কিডনি দুর্বল হয়ে যায়।
বাংলাদেশের রান্নায় লাল মাংস সাধারণত অতিরিক্ত তেল, লবণ ও মসলা দিয়ে রান্না করা হয়। এগুলো কিডনির জন্য আরও ক্ষতিকর। তাই কিডনিতে পাথর থাকলে লাল মাংস পুরোপুরি বাদ না দিলেও পরিমাণে খুব সীমিত রাখতে হবে — সপ্তাহে একবার, ছোট পরিমাণে এবং সেদ্ধ বা গ্রিল করা অবস্থায় খাওয়া সবচেয়ে ভালো।
🌿 ৩. পালং শাক
পালং শাক আমাদের দেশের অত্যন্ত জনপ্রিয় ও পুষ্টিকর সবজি। এতে রয়েছে ভিটামিন এ, সি, কে, আয়রন ও ক্যালসিয়ামের মতো গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। কিন্তু কিডনিতে পাথর যাদের আছে, তাদের জন্য এই শাকটি হতে পারে বিপদের কারণ। কারণ পালং শাকে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে অক্সালেট (Oxalate), যা শরীরে ক্যালসিয়ামের সঙ্গে যুক্ত হয়ে ক্যালসিয়াম অক্সালেট পাথর তৈরি করে।
বাংলাদেশে কিডনিতে পাথরের বেশিরভাগই ক্যালসিয়াম অক্সালেট জাতীয়, আর এর পেছনে বড় ভূমিকা রাখে পালং শাকের মতো উচ্চ-অক্সালেট খাবার। যখন শরীরে অতিরিক্ত অক্সালেট জমে যায়, তখন কিডনি তা সম্পূর্ণভাবে প্রস্রাবের মাধ্যমে বের করতে পারে না। ফলস্বরূপ, অক্সালেট ক্যালসিয়ামের সঙ্গে মিশে ছোট ছোট দানা তৈরি করে, যা সময়ের সঙ্গে পাথরে রূপ নেয়।
অনেকেই মনে করেন, শাকসবজি সবসময়ই স্বাস্থ্যকর, তাই যত বেশি খাওয়া যায় তত ভালো — কিন্তু কিডনি রোগীদের জন্য এটি পুরোপুরি সঠিক নয়। বিশেষ করে যারা আগে কখনও পাথরের সমস্যায় ভুগেছেন, তাদের পালং শাক খুব সতর্কতার সঙ্গে খেতে হবে।
বাংলাদেশে পালং শাক সারা বছরই পাওয়া যায় এবং সাধারণত এটি দিয়ে ভর্তা, ডাল, মাছ বা আলু দিয়ে রান্না করা হয়। এই রান্নায় লবণ ও মসলা বেশি ব্যবহার করলে কিডনির ক্ষতি আরও বাড়ে, কারণ লবণও পাথর তৈরিতে সহায়তা করে।
তবে এর মানে এই নয় যে পালং শাক একেবারেই খাওয়া যাবে না। ডাক্তারের পরামর্শে সীমিত পরিমাণে খাওয়া যেতে পারে, তবে কিছু নিয়ম মেনে চলা জরুরি —
- পালং শাক ভালোভাবে সিদ্ধ করে খেলে অক্সালেটের পরিমাণ কিছুটা কমে যায়।
- রান্নার আগে গরম পানিতে সামান্য সময় সিদ্ধ করে পানি ফেলে দিলে অতিরিক্ত অক্সালেট বের হয়ে যায়।
- পালং শাক খাওয়ার পর পর্যাপ্ত পানি পান করতে হবে, যাতে শরীর থেকে অক্সালেট প্রস্রাবের মাধ্যমে বের হয়ে যায়।
যাদের কিডনিতে পাথর হওয়ার ঝুঁকি আছে, তারা পালং শাকের পরিবর্তে লাউ, করলা, পুঁই, কচুপাতা বা শসা জাতীয় কম অক্সালেট শাকসবজি খেতে পারেন। এসব খাবার কিডনি পরিষ্কার রাখতে সাহায্য করে এবং পাথর প্রতিরোধে ভূমিকা রাখে।
এছাড়া পালং শাকের সঙ্গে যদি বেশি প্রোটিন বা লবণযুক্ত খাবার (যেমন শুকনো মাছ, ডাল, মাংস) খাওয়া হয়, তাহলে পাথর হওয়ার ঝুঁকি আরও বেড়ে যায়। তাই একসঙ্গে এই ধরনের খাবার খাওয়া এড়িয়ে চলাই ভালো।
সংক্ষেপে বলা যায় —
পালং শাক একটি পুষ্টিকর খাবার হলেও, কিডনিতে পাথর বা পাথরের ঝুঁকি থাকলে এটি পরিমিত পরিমাণে খাওয়া উচিত। সঠিকভাবে সিদ্ধ করে এবং পর্যাপ্ত পানি পান করে খেলে ক্ষতির আশঙ্কা অনেক কমে যায়।
সুতরাং, স্বাস্থ্য সচেতনভাবে খাদ্য বাছাই করলেই আপনি পাথর থেকে নিরাপদ থাকতে পারবেন।
🥜 ৪. বাদাম ও বীজজাতীয় খাবার
বাদাম ও বীজজাতীয় খাবার শরীরের জন্য পুষ্টিকর হলেও, কিডনিতে পাথর যাদের আছে বা হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে, তাদের জন্য এটি হতে পারে এক নীরব বিপদ। কারণ এসব খাবারে থাকে প্রচুর পরিমাণে অক্সালেট (Oxalate) — যা কিডনিতে ক্যালসিয়াম অক্সালেট পাথর তৈরির প্রধান উপাদান।
বাংলাদেশে মানুষ সাধারণত বিকেলের নাস্তা হিসেবে কাজুবাদাম, চিনাবাদাম বা সূর্যমুখীর বীজ খেয়ে থাকে। আবার অনেকেই প্রতিদিনের খাবারে সালাদে বা দইয়ের সঙ্গে এসব বীজ মিশিয়ে খান। এসব খাবারে প্রোটিন, ফ্যাট ও ভিটামিন ই থাকলেও, অতিরিক্ত খেলে শরীরে অক্সালেট জমে যায়। যখন এই অক্সালেট প্রস্রাবের মাধ্যমে পুরোপুরি বের হতে পারে না, তখন তা ক্যালসিয়ামের সঙ্গে মিশে কিডনিতে দানা তৈরি করে — যা সময়ের সঙ্গে পাথরে পরিণত হয়।
বিশেষ করে যেসব বাদামে অক্সালেটের মাত্রা বেশি, যেমন কাঠবাদাম, কাজুবাদাম, চিনাবাদাম, আখরোট, পিস্তাবাদাম, সূর্যমুখীর বীজ, তিলবীজ ও ফ্ল্যাক্স সিড, সেগুলো কিডনি রোগীদের জন্য সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ। প্রতিদিন এই বাদামগুলো অল্প পরিমাণেও নিয়মিত খেলে পাথর হওয়ার সম্ভাবনা বাড়ে, বিশেষত যদি পানি কম খাওয়া হয়।
অনেকেই ভাবেন, বাদাম প্রাকৃতিক খাবার, তাই যত খুশি খাওয়া যায় — কিন্তু কিডনি যাদের দুর্বল, তাদের শরীরে এই অতিরিক্ত অক্সালেট জমে বিপদ ডেকে আনতে পারে। তাই ডাক্তাররা সাধারণত পাথর রোগীদের বাদাম সম্পূর্ণ এড়িয়ে চলার পরামর্শ দেন।
তবে সব বাদামই যে ক্ষতিকর তা নয়। কিছু বাদামে অক্সালেটের পরিমাণ তুলনামূলক কম থাকে, যেমন ম্যাকাডেমিয়া বাদাম বা চেস্টনাট। কিন্তু এসব বাদাম বাংলাদেশে সহজলভ্য নয় এবং দামও বেশি, তাই বাস্তবিকভাবে আমাদের দেশের মানুষের জন্য বাদাম সীমিত রাখাই বুদ্ধিমানের কাজ।
🥤 ৫. সফট ড্রিংক ও কোলা
বাংলাদেশে সফট ড্রিংক বা কোলার জনপ্রিয়তা দিন দিন বাড়ছে। বিশেষ করে গরমের সময় ঠান্ডা পানীয় অনেকের কাছে একপ্রকার তৃষ্ণা নিবারণের মাধ্যম। কিন্তু বাস্তবে এই পানীয়গুলো শরীর ঠান্ডা করলেও কিডনির জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। যারা কিডনিতে পাথর, ইউরিক অ্যাসিড বা প্রস্রাবে জ্বালাপোড়া সমস্যায় ভুগছেন, তাদের জন্য সফট ড্রিংক সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ করা উচিত।
কেননা এই পানীয়গুলোর মূল উপাদান হলো ফসফরিক অ্যাসিড (Phosphoric Acid) ও ক্যাফেইন (Caffeine)। ফসফরিক অ্যাসিড শরীরের ক্যালসিয়াম ভারসাম্য নষ্ট করে দেয়। যখন শরীরে ক্যালসিয়াম কমে যায়, তখন শরীর হাড় থেকে ক্যালসিয়াম টেনে নেয়, যা পরে কিডনিতে গিয়ে জমা হয় এবং ক্যালসিয়াম ফসফেট বা ক্যালসিয়াম অক্সালেট পাথর তৈরি করে।
অন্যদিকে, ক্যাফেইন শরীরকে ডিহাইড্রেট করে, অর্থাৎ শরীর থেকে অতিরিক্ত পানি বের করে দেয়। ফলে প্রস্রাব ঘন হয়ে যায় এবং কিডনিতে খনিজ পদার্থ জমে যায়। এটি পাথর গঠনের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করে।
বাংলাদেশে বিশেষ করে তরুণ প্রজন্ম ও কর্মজীবী মানুষদের মধ্যে সফট ড্রিংক খাওয়ার অভ্যাস বেড়েছে। অফিসে, পার্টিতে, রেস্টুরেন্টে বা ঘরোয়া অনুষ্ঠানে— প্রায় সর্বত্রই কোলা, স্প্রাইট বা অন্য কোনো সফট ড্রিংক থাকে। অনেকেই দিনে একাধিকবার এসব পানীয় পান করেন, যা দীর্ঘমেয়াদে কিডনির ক্ষতি করে।
এই পানীয়গুলোতে প্রচুর চিনি (Sugar) থাকে। এক বোতল ৫০০ মি.লি. কোলায় প্রায় ১২-১৪ চা চামচ চিনি থাকে, যা শরীরের ইনসুলিন ভারসাম্য নষ্ট করে এবং কিডনিতে ইউরিক অ্যাসিডের মাত্রা বাড়ায়। এতে শুধু পাথর নয়, ডায়াবেটিস, স্থূলতা ও উচ্চ রক্তচাপও হতে পারে — যা কিডনির কার্যক্ষমতা আরও কমিয়ে দেয়।
অনেকে মনে করেন “ডায়েট কোক” বা “চিনি ছাড়া কোলা” নিরাপদ। কিন্তু তাতেও কৃত্রিম মিষ্টিকারক (Aspartame) ও রাসায়নিক সংযোজন থাকে, যা কিডনির ফিল্টারিং সিস্টেমকে ধীরে ধীরে দুর্বল করে দেয়।
🍅 ৬. টমেটো বীজসহ
টমেটো বাংলাদেশের রান্নায় একটি অপরিহার্য উপাদান। সালাদ থেকে শুরু করে তরকারি, স্যুপ কিংবা চাটনি— প্রায় সব খাবারেই টমেটো ব্যবহার করা হয়। এতে ভিটামিন A, C, K, পটাশিয়াম ও অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট (বিশেষ করে লাইকোপিন) প্রচুর পরিমাণে থাকে, যা শরীরের জন্য উপকারী। কিন্তু কিডনির সমস্যায় ভোগা ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে টমেটোর বীজসহ টমেটো খাওয়া মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে।
টমেটোর বীজে প্রচুর পরিমাণে অক্সালেট (Oxalate) নামক যৌগ থাকে। এই অক্সালেট শরীরে ক্যালসিয়ামের সঙ্গে যুক্ত হয়ে ক্যালসিয়াম অক্সালেট পাথর তৈরি করে — যা কিডনিতে পাথর গঠনের সবচেয়ে সাধারণ ধরন। যদি কারও কিডনিতে পাথর হওয়ার প্রবণতা থাকে বা আগে কখনো পাথর হয়েছে, তাহলে বীজসহ টমেটো খাওয়া তার জন্য একেবারে অনুপযুক্ত।
বাংলাদেশের অনেকেই টমেটো সালাদ বা চাটনিতে বীজসহ খান, কারণ এতে স্বাদ বাড়ে এবং দেখতে আকর্ষণীয় লাগে। কিন্তু এই ছোট ছোট বীজগুলো হজম হয় না, বরং পরিপাকতন্ত্র হয়ে কিডনিতে গিয়ে জমে থাকে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এগুলো খনিজ পদার্থের সঙ্গে মিশে পাথর তৈরি করে।
আরেকটি বিষয় হলো— অনেক সময় বাজারে পাওয়া টমেটোতে কীটনাশক ও রাসায়নিক রং ব্যবহার করা হয়। এই রাসায়নিকগুলো শরীরের ফিল্টার হিসেবে কাজ করা কিডনির উপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করে। ফলে কিডনি ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং বর্জ্য ফিল্টার করার ক্ষমতা কমে যায়।
যারা কিডনিতে পাথর, ইউরিক অ্যাসিড বা কিডনি ফাংশন কমে যাওয়ার সমস্যায় ভুগছেন, তাদের জন্য বীজবিহীন টমেটো বা সিদ্ধ করে ছেঁকে নেওয়া টমেটো খাওয়া নিরাপদ। উদাহরণস্বরূপ, টমেটো স্যুপ তৈরি করার সময় আগে টমেটো ভালোভাবে সিদ্ধ করে বীজ ছেঁকে ফেললে টমেটোর ভিটামিন ও অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট পাওয়া যায়, কিন্তু অক্সালেটের ক্ষতি থেকে রক্ষা পাওয়া যায়।
বাংলাদেশের আবহাওয়া ও খাবার সংস্কৃতিতে কিডনি সমস্যা ক্রমেই বাড়ছে, বিশেষত যারা পর্যাপ্ত পানি পান করেন না এবং অতিরিক্ত প্রোটিন, লবণ বা সফট ড্রিংক গ্রহণ করেন। এই অবস্থায় টমেটো বীজসহ খাওয়া আরও বিপজ্জনক হতে পারে, কারণ এটি পাথর তৈরির প্রক্রিয়াকে দ্রুততর করে।
তাছাড়া, টমেটোর বীজ হজমে কষ্টকর হওয়ায় গ্যাস, অম্বল ও পেট ফাঁপা সমস্যা বাড়াতে পারে। বিশেষ করে গরম মসলাযুক্ত রান্নায় টমেটো বীজসহ দিলে হজম প্রক্রিয়া আরও ব্যাহত হয়, যা কিডনি ও পরিপাকতন্ত্রের উপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করে।
🍗 ৭. অতিরিক্ত প্রাণিজ প্রোটিন
বাংলাদেশে দৈনন্দিন খাবারে মাছ, মাংস, ডিম, দুধ— এসব প্রাণিজ প্রোটিনের উৎস খুব সাধারণ। এগুলো শরীরের জন্য অপরিহার্য, কারণ এতে থাকে অ্যামিনো অ্যাসিড, আয়রন, জিঙ্ক ও ভিটামিন বি১২, যা পেশি গঠন, রক্ত তৈরি ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। কিন্তু কিডনিতে পাথর বা কিডনি সম্পর্কিত যেকোনো সমস্যা থাকলে অতিরিক্ত প্রাণিজ প্রোটিন খাওয়া বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে।
কিডনির প্রধান কাজ হলো শরীরের বর্জ্য পদার্থ ছেঁকে প্রস্রাবের মাধ্যমে বের করে দেওয়া। কিন্তু যখন কেউ বেশি প্রোটিন খায়— বিশেষ করে গরুর মাংস, খাসির মাংস, মুরগি বা ডিমের কুসুমের মতো প্রাণিজ উৎস থেকে— তখন শরীরে ইউরিক অ্যাসিড ও ক্যালসিয়াম নামক পদার্থের পরিমাণ বেড়ে যায়। এই দুটি উপাদানই কিডনিতে পাথর গঠনের জন্য দায়ী।
অতিরিক্ত প্রাণিজ প্রোটিন গ্রহণে প্রস্রাবের অম্লীয়তা (Acidity) বেড়ে যায়, ফলে শরীরের পিএইচ ভারসাম্য নষ্ট হয়। এতে কিডনি অতিরিক্ত পরিশ্রম করে বর্জ্য ছাঁকতে গিয়ে ধীরে ধীরে দুর্বল হয়ে পড়ে। দীর্ঘদিন এমন অবস্থা চলতে থাকলে কিডনিতে ক্ষুদ্র ক্যালসিয়াম কণা জমে পাথর তৈরি হয়।
বাংলাদেশে অনেকেই ওজন কমানোর জন্য বা পেশি বাড়ানোর উদ্দেশ্যে বেশি মাংস ও ডিম খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তুলেছেন। কিন্তু এই অভ্যাস কিডনির জন্য ভয়ংকর হতে পারে। কারণ প্রোটিন ভাঙার সময় অ্যামোনিয়া ও ইউরিয়া তৈরি হয়, যা কিডনিকে পরিষ্কার করতে হয়। বেশি প্রোটিন মানেই কিডনির ওপর অতিরিক্ত চাপ।
এছাড়া, গরু ও খাসির মাংস রান্নার সময় ব্যবহৃত অতিরিক্ত তেল, লবণ ও মসলা কিডনির ক্ষতি আরও বাড়ায়। মসলাযুক্ত খাবার শরীরে সোডিয়ামের মাত্রা বাড়ায়, যা প্রস্রাবের মাধ্যমে ক্যালসিয়াম নিঃসরণ বাড়িয়ে দেয়। এতে পাথর হওয়ার ঝুঁকি দ্বিগুণ হয়ে যায়।
🥤 ৮. সফট ড্রিংক ও সোডা জাতীয় পানীয়
বাংলাদেশে এখনকার তরুণ প্রজন্ম থেকে শুরু করে প্রাপ্তবয়স্ক— প্রায় সবাই কমবেশি সফট ড্রিংক ও সোডা জাতীয় পানীয় পান করে থাকেন। গরমে ঠান্ডা পানীয় খাওয়ার অভ্যাস অনেকের কাছে দৈনন্দিন রুটিনে পরিণত হয়েছে। কিন্তু এই অভ্যাস নিঃশব্দে কিডনির জন্য ভয়ংকর ক্ষতির কারণ হয়ে উঠছে। বিশেষ করে যারা কিডনিতে পাথরের সমস্যায় ভুগছেন, তাদের জন্য সফট ড্রিংক যেন ধীরে ধীরে বিষের মতো কাজ করে।
সফট ড্রিংক বা কার্বনেটেড পানীয়তে প্রচুর পরিমাণে ফসফরিক অ্যাসিড (Phosphoric Acid), চিনি (Sugar) ও ক্যাফেইন (Caffeine) থাকে। এই উপাদানগুলো কিডনিতে ক্যালসিয়াম ও অক্সালেটের ভারসাম্য নষ্ট করে, ফলে প্রস্রাবে ক্যালসিয়ামের পরিমাণ বেড়ে যায়। এতে করে কিডনিতে পাথর তৈরি হওয়ার ঝুঁকি বহুগুণ বেড়ে যায়।
বাংলাদেশের বাজারে পাওয়া অধিকাংশ কোমল পানীয় যেমন— কোক, পেপসি, স্প্রাইট, ৭আপ, মিরিন্ডা, মাউন্টেন ডিউ ইত্যাদি— সবগুলোতেই ফসফেট ও কৃত্রিম রং ব্যবহার করা হয়। ফসফেট শরীরে জমে কিডনির ফিল্টারিং ক্ষমতা কমিয়ে দেয়, আর কৃত্রিম রং কিডনি টিস্যুতে বিষাক্ত প্রভাব ফেলে।
আরেকটি বড় সমস্যা হলো — সফট ড্রিংক শরীরকে ডিহাইড্রেটেড (পানিশূন্য) করে ফেলে। এতে প্রস্রাব ঘন হয়ে যায় এবং কিডনির ভেতরে খনিজ পদার্থ জমতে থাকে, যা সময়ের সঙ্গে পাথরে রূপ নেয়। অনেকেই গরমের সময় পানি না খেয়ে শুধু সফট ড্রিংক পান করেন, যা কিডনির জন্য সবচেয়ে বড় ভুল।
চিনিযুক্ত পানীয় নিয়মিত খেলে শরীরে ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স ও ডায়াবেটিস বাড়ে, যা আবার কিডনি রোগের অন্যতম প্রধান কারণ। ডায়াবেটিক কিডনি ডিজিজে আক্রান্ত অনেক রোগীই জানিয়েছেন, তারা দীর্ঘদিন ধরে সফট ড্রিংক খাওয়ার অভ্যাসে ছিলেন।
☕ ৯. কফি ও চা অতিরিক্ত পরিমাণে
বাংলাদেশে কফি এবং চা পান করা দৈনন্দিন অভ্যাসের অংশ। চা তো প্রায় প্রতিটি ঘরে সকালের রুটিন, আর কফি বিশেষ করে তরুণ ও অফিসজীবীদের মধ্যে দিন শুরু করার শক্তি হিসেবে জনপ্রিয়। কিন্তু কিডনিতে পাথর থাকলে বা কিডনির সমস্যার ঝুঁকি থাকলে অতিরিক্ত কফি ও চা পান করা মারাত্মক ক্ষতিকর হতে পারে।
কফি ও চায় রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ক্যাফেইন (Caffeine), যা শরীরকে ডিহাইড্রেট করে। অর্থাৎ শরীর থেকে পানি বেরিয়ে যায় এবং প্রস্রাব ঘন হয়। ঘন প্রস্রাব কিডনিতে খনিজ পদার্থ জমার প্রধান কারণ, যা ধীরে ধীরে পাথরের আকার নেয়। বিশেষ করে যারা দিনে ৩–৫ কাপ চা বা কফির বেশি পান করেন, তাদের ক্ষেত্রে পাথর তৈরি হওয়ার ঝুঁকি অনেক বেশি।
চায় এবং কফিতে আরও থাকে অক্সালেট (Oxalate), যা ক্যালসিয়ামের সঙ্গে মিশে ক্যালসিয়াম অক্সালেট পাথর তৈরি করে। বাংলাদেশের মানুষ সাধারণত চা কালি, দুধ ও চিনি মিশিয়ে পান করে। এতে ক্যাফেইন ও চিনি একসাথে কাজ করে কিডনিকে চাপের মধ্যে ফেলে।
অনেকেই মনে করেন, “চা বা কফি স্বাভাবিকভাবে শরীরকে সতেজ রাখে, তাই যত খুশি খাওয়া যায়।” কিন্তু কিডনিতে পাথর থাকা অবস্থায় এটি বিপজ্জনক। অতিরিক্ত চা বা কফি খেলে কিডনির ফিল্টারিং সিস্টেমে চাপ পড়ে, ইউরিক অ্যাসিড ও ক্যালসিয়াম প্রস্রাবে ঠিকভাবে বের হতে পারে না। ফলে ক্ষুদ্র কণা ধীরে ধীরে পাথরে রূপ নেয়।
বাংলাদেশে চা খাওয়ার সময় সাধারণত নোনতা বা মিষ্টি খাবারের সঙ্গে খাওয়া হয়। এ ধরনের সংমিশ্রণ কিডনির জন্য আরও ক্ষতিকর, কারণ সোডিয়াম ও চিনি ক্যালসিয়ামের নিঃসরণ বাড়িয়ে পাথর তৈরির ঝুঁকি বাড়ায়। এছাড়া যারা কফি পান করেন, তাদের মধ্যে অনেকেই দিনে একাধিকবার স্প্রিংক বা ফাস্টফুডের সঙ্গে কফি পান করেন, যা কিডনির উপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করে।
একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের জন্য দৈনিক ১–২ কাপ চা বা ১ কাপ কফি নিরাপদ। তবে কিডনিতে পাথর বা ইউরিক অ্যাসিডের সমস্যা থাকলে এটি আরও সীমিত রাখা উচিত। বিকল্প হিসেবে, হরবাল টি, লেবু পানি, বা বার্লি পানি গ্রহণ করা অনেক বেশি নিরাপদ।
এছাড়া চা বা কফি খাওয়ার সময় পর্যাপ্ত পানি পান করা জরুরি। দিনে অন্তত ২.৫–৩ লিটার পানি পান করলে প্রস্রাব পাতলা থাকে এবং কিডনিতে জমে থাকা খনিজ পদার্থ সহজে বের হয়।
💊 ১০. অতিরিক্ত ভিটামিন সাপ্লিমেন্ট
আজকের দিনে অনেকেই স্বাস্থ্য সচেতন হওয়ার জন্য বিভিন্ন ভিটামিন ও মিনারেল সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ করেন। তবে কিডনিতে পাথর বা কিডনির সমস্যা থাকলে অতিরিক্ত ভিটামিন সাপ্লিমেন্ট খাওয়া বিপজ্জনক হতে পারে। বিশেষ করে ভিটামিন সি (Vitamin C) ও ভিটামিন ডি (Vitamin D) অতিরিক্ত গ্রহণ কিডনিতে পাথর তৈরির ঝুঁকি বাড়ায়।
ভিটামিন সি শরীরে প্রবেশ করলে তা ভাঙে এবং অক্সালেট উৎপন্ন করে। অতিরিক্ত অক্সালেট ক্যালসিয়ামের সঙ্গে যুক্ত হয়ে কিডনিতে জমা হয় এবং ধীরে ধীরে ক্যালসিয়াম অক্সালেট পাথর তৈরি করে। তাই যাদের কিডনিতে পাথরের ইতিহাস আছে, তারা কখনোই নিজে থেকে উচ্চমাত্রার ভিটামিন সি খাওয়া উচিত নয়।
ভিটামিন ডি ও খনিজ সমৃদ্ধ সাপ্লিমেন্টও কিডনির উপর চাপ ফেলে। অতিরিক্ত ভিটামিন ডি শরীরে ক্যালসিয়ামের শোষণ বাড়িয়ে দেয়, যা রক্তে ক্যালসিয়ামের মাত্রা বৃদ্ধি করে। রক্তে বেশি ক্যালসিয়াম থাকার ফলে কিডনিতে খনিজ পদার্থ জমে যায় এবং পাথর তৈরির সম্ভাবনা বেড়ে যায়।
বাংলাদেশে অনেকেই ধারণা করেন, “ভিটামিন যত বেশি তত স্বাস্থ্যকর।” কিন্তু এটি পুরোপুরি ভুল। অতিরিক্ত সাপ্লিমেন্ট কিডনি ফিল্টারিং সিস্টেমকে ক্লান্ত করে এবং দীর্ঘমেয়াদে কিডনি ফেইলিওর বা পাথর তৈরির সম্ভাবনা বৃদ্ধি করে।
সাপ্লিমেন্ট নেওয়ার সময় ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া অত্যন্ত জরুরি। যাদের কিডনিতে সমস্যা রয়েছে, তারা ভিটামিন গ্রহণের ক্ষেত্রে বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। এছাড়া, সাপ্লিমেন্টের পরিবর্তে প্রাকৃতিক খাদ্য উৎস যেমন ফল, শাক-সবজি, দুধ, ডাল ও মাছ থেকে প্রয়োজনীয় ভিটামিন ও খনিজ নেওয়া সবচেয়ে নিরাপদ।
বাংলাদেশে বাজারে সহজলভ্য ভিটামিন ট্যাবলেট ও সিরাপগুলোতে একাধিক উপাদান থাকে। যদি এগুলো একসাথে বেশি পরিমাণে গ্রহণ করা হয়, তবে কিডনির ফিল্টারিং ক্ষমতা অক্ষম হয়ে যেতে পারে। বিশেষ করে যাদের কিডনিতে ইতিমধ্যেই পাথর আছে, তাদের জন্য এটি আরও বিপজ্জনক।
🩺 কিডনিতে পাথর কেন হয়?

কিডনিতে পাথর হওয়া বা কিডনি স্টোন একটি সাধারণ সমস্যা, যা বাংলাদেশের অনেক মানুষকে প্রভাবিত করে। মূলত কিডনি পাথর তৈরি হয় তখন, যখন শরীরের প্রস্রাবে থাকা খনিজ ও লবণসমূহের ঘনত্ব বেড়ে যায় এবং এগুলো একত্র হয়ে কঠিন পদার্থে পরিণত হয়। ক্যালসিয়াম, অক্সালেট, ইউরিক অ্যাসিড, সিস্টিন প্রভৃতি পদার্থ কিডনিতে জমে পাথর তৈরি করে।
একটি প্রধান কারণ হলো পর্যাপ্ত পানি না খাওয়া। পানি কম খেলে প্রস্রাব ঘন হয়, ফলে খনিজ পদার্থ সহজে জমে পাথর তৈরি করে। বাংলাদেশে গরম আবহাওয়া এবং অনিয়মিত পানি পান করার কারণে এই সমস্যা বেশি দেখা যায়।
দ্বিতীয় কারণ হলো খাবারের অভ্যাস। বেশি লবণযুক্ত, প্রোটিন সমৃদ্ধ, অক্সালেটযুক্ত খাবার বা সফট ড্রিংক খেলে কিডনিতে খনিজ পদার্থ জমতে শুরু করে। উদাহরণস্বরূপ— লাল মাংস, পালং শাক, বাদাম, টমেটো বীজসহ, চা ও কফি অতিরিক্ত খাওয়া ইত্যাদি কিডনিতে পাথর তৈরিতে সহায়তা করে।
ইউরিক অ্যাসিডের মাত্রা বেশি থাকা আরেকটি বড় কারণ। ইউরিক অ্যাসিড পাথর সাধারণত বেশি প্রোটিন খাওয়ার ফলে তৈরি হয়। এটি কিডনিতে ছোট ছোট ক্রিস্টাল তৈরি করে, যা ধীরে ধীরে পাথরে পরিণত হয়।
কিডনিতে পাথর হওয়ার জন্য জিনগত প্রবণতাও একটি কারণ। কারও পরিবারে যদি কিডনি পাথরের ইতিহাস থাকে, তাহলে সেই পরিবারের সদস্যদের মধ্যে এই রোগ হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে।
অতিরিক্ত ওজন ও স্থূলতা কিডনিতে পাথর তৈরিতে সহায়ক। শরীরে চর্বি বেশি থাকলে ইউরিক অ্যাসিড এবং ক্যালসিয়ামের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়, যা কিডনিতে জমে পাথর তৈরি করে।
ডিহাইড্রেশন বা পানিশূন্যতা এছাড়া প্রস্রাবের পিএইচ পরিবর্তন করে। কিডনিতে খনিজ পদার্থ কখনও অতিরিক্ত অ্যাসিডিক বা ক্ষারীয় পরিবেশে জমে পাথর তৈরি করে। তাই পানি পান কম হলে পাথর তৈরির ঝুঁকি বেড়ে যায়।
বহুল জিজ্ঞাসিত প্রশ্ন ও উত্তর সমূহ
কিডনিতে পাথর হলে কি খাওয়া যাবে না?এই বিষয়ে আপনার মনে বেশ কয়েকটি প্রশ্ন উঁকি দিচ্ছে? তাহলে চলুন জেনে নেই সেই সকল প্রশ্ন ও উত্তরগুলো-
কিডনিতে পাথর হলে কি সম্পূর্ণ প্রোটিন খাওয়া বন্ধ করতে হবে?
সম্পূর্ণ প্রোটিন খাওয়া বন্ধ করার প্রয়োজন নেই। তবে অতিরিক্ত প্রাণিজ প্রোটিন সীমিত পরিমাণে খেতে হবে। মাছ, ডিম বা মাংস সপ্তাহে কয়েকবার পরিমিত পরিমাণে খেলে কিডনির ওপর চাপ কমে এবং পাথর তৈরির ঝুঁকি কমে। পাশাপাশি পর্যাপ্ত পানি পান করা অত্যন্ত জরুরি।
কিডনিতে পাথর থাকলে কোন পানীয় সবচেয়ে নিরাপদ?
পানি সবসময় সবচেয়ে নিরাপদ। এছাড়া ডাবের পানি, লেবুর পানি, বার্লি পানি বা প্রাকৃতিক ফলের রস কিডনিকে হাইড্রেটেড রাখে এবং প্রস্রাব পাতলা করে। সফট ড্রিংক, সোডা ও অতিরিক্ত চা-কফি এড়িয়ে চলাই কিডনিকে সুস্থ রাখার জন্য জরুরি।
🏁 উপসংহার
কিডনিতে পাথর হওয়া একটি সাধারণ কিন্তু জটিল সমস্যা। বাংলাদেশের খাদ্যাভ্যাস, গরম আবহাওয়া, পানির অভাব এবং অনিয়মিত জীবনধারা কিডনিতে পাথর হওয়ার ঝুঁকি বাড়ায়। পাথর সাধারণত ক্যালসিয়াম, অক্সালেট, ইউরিক অ্যাসিড বা সিস্টিনের জমার ফলে তৈরি হয়। যখন প্রস্রাবে এই খনিজ পদার্থের ঘনত্ব বেড়ে যায়, তখন ছোট ছোট ক্রিস্টাল কিডনিতে জমে ধীরে ধীরে পাথরে রূপ নেয়।
পাথর হওয়ার কারণগুলোকে চিহ্নিত করা গেলে এবং সচেতনভাবে খাদ্য ও পানির অভ্যাস পরিবর্তন করা গেলে কিডনির ক্ষতি রোধ করা সম্ভব। অতিরিক্ত লবণ, প্রোটিন, সফট ড্রিংক, চা-কফি, বাদাম, টমেটো বীজসহ খাবার, এবং অযথা ভিটামিন সাপ্লিমেন্ট কিডনিতে পাথর তৈরিতে সহায়ক। অপরদিকে, পর্যাপ্ত পানি পান, প্রাকৃতিক খাবার বেছে নেওয়া, এবং ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী জীবনধারা মানা কিডনি সুস্থ রাখতে সাহায্য করে।
সংক্ষেপে বলতে গেলে— কিডনির যত্ন নেওয়া মানে সচেতন খাদ্যাভ্যাস, পর্যাপ্ত পানি, সীমিত প্রোটিন ও লবণ, এবং অতিরিক্ত রাসায়নিক ও সফট ড্রিংক থেকে বিরত থাকা। এসব অভ্যাস মানলে কিডনিতে পাথর হওয়া প্রতিরোধ করা সম্ভব এবং কিডনি দীর্ঘদিন সুস্থ থাকে।