ছেলেদের টেস্টোস্টেরন হরমোন বেড়ে গেলে কি হয়?
মানুষের শরীরে এমন অনেক হরমোন আছে, যেগুলোর ভারসাম্যের উপর পুরো দেহের কার্যক্রম নির্ভর করে। এর মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ হরমোন হলো টেস্টোস্টেরন (Testosterone)। এটি সাধারণত ছেলেদের শরীরে বেশি পরিমাণে উৎপন্ন হয় এবং পুরুষের শারীরিক ও মানসিক গঠনে বড় ভূমিকা রাখে। কৈশোরে পৌঁছানোর পর থেকেই টেস্টোস্টেরন হরমোনের মাত্রা দ্রুত বাড়তে থাকে, যা দাড়ি-গোঁফ গজানো, কণ্ঠ গভীর হওয়া, পেশি বৃদ্ধি, এবং যৌন ইচ্ছা জাগ্রত করার মতো পরিবর্তন ঘটায়।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে দেখা যায়, অনেক তরুণ তাদের শরীর ও হরমোন নিয়ে সচেতন নয়। তারা জানে না টেস্টোস্টেরন ঠিক কীভাবে কাজ করে, কখন এটি কমে যায় বা বেড়ে যায়, কিংবা এর প্রভাব শরীর ও মনের উপর কেমন পড়ে। শহর বা গ্রাম – যেখানেই হোক, জীবনযাপনের ধরন, খাবার, ঘুম, মানসিক চাপ—সবকিছুই এই হরমোনের উপর প্রভাব ফেলে।
বিশেষ করে আধুনিক জীবনযাপনে ঘুমের অভাব, অতিরিক্ত মোবাইল ব্যবহার, শারীরিক পরিশ্রমের অভাব, এবং অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাসের কারণে অনেক তরুণের টেস্টোস্টেরন হরমোন কমে যাচ্ছে। এর ফলস্বরূপ তারা ক্লান্তি, মনোযোগের ঘাটতি, যৌন দুর্বলতা, এমনকি বিষণ্নতার মতো সমস্যায় পড়ছে। আবার কেউ কেউ অজান্তেই ওষুধ বা সাপ্লিমেন্ট ব্যবহার করে টেস্টোস্টেরন বাড়াতে গিয়ে উল্টো ক্ষতির মুখে পড়ছে।
এই ব্লগে আমরা জানব — টেস্টোস্টেরন হরমোনের কাজ কী, এটি বেড়ে গেলে বা কমে গেলে শরীরে কী ঘটে, এবং বাংলাদেশে ছেলেদের মধ্যে এই হরমোনের ভারসাম্য রক্ষা করার কার্যকর উপায় কী হতে পারে। পাঠক যেন সহজ ভাষায় বিষয়টি বুঝতে পারেন, সেদিকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
যে কেউ যদি নিজের শরীর ও স্বাস্থ্যের প্রতি সচেতন হতে চান, বিশেষ করে পুরুষদের জন্য এই লেখা হবে একটি তথ্যবহুল নির্দেশিকা। কারণ টেস্টোস্টেরন শুধু যৌনশক্তি নয়, এটি পুরো দেহের শক্তি, আত্মবিশ্বাস ও মানসিক স্থিতিশীলতার সাথে যুক্ত। তাই এই হরমোনের ভূমিকা ও গুরুত্ব সম্পর্কে জানা প্রতিটি পুরুষের জন্য প্রয়োজনীয়।
টেস্টোস্টেরন হরমোনের কাজ কি?

টেস্টোস্টেরন হরমোন হলো এমন একটি প্রাকৃতিক রাসায়নিক পদার্থ যা মূলত পুরুষদের অণ্ডকোষ থেকে নিঃসৃত হয়। অল্প পরিমাণে এটি নারীদের শরীরেও থাকে, তবে পুরুষদের মধ্যে এর মাত্রা অনেক বেশি। এটি মানুষের দেহে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কাজ করে, যা শুধু যৌন ক্ষমতার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। বরং এটি শারীরিক, মানসিক, এমনকি সামাজিক আচরণ পর্যন্ত প্রভাবিত করে।
প্রথমত, টেস্টোস্টেরন ছেলেদের যৌবনকালীন বিকাশের মূল নিয়ামক। যখন একজন ছেলেবেলা থেকে কিশোরে পরিণত হয়, তখনই এই হরমোনের মাত্রা হঠাৎ বৃদ্ধি পেতে শুরু করে। এর ফলে কণ্ঠস্বর ভারী হয়, দাড়ি-গোঁফ গজায়, শরীরের গঠন শক্তিশালী হয় এবং পেশির বৃদ্ধি ঘটে। এই পরিবর্তনগুলোই একজন ছেলেকে শারীরিকভাবে একজন পুরুষে পরিণত করে।
দ্বিতীয়ত, টেস্টোস্টেরন হরমোন শরীরের পেশি ও হাড়ের ঘনত্ব বাড়াতে সাহায্য করে। এই হরমোন যথাযথ মাত্রায় থাকলে শরীর শক্তিশালী হয়, ব্যায়ামের ফল দ্রুত পাওয়া যায়, এবং ক্লান্তি কমে। যারা নিয়মিত ব্যায়াম করেন বা ফিটনেস বজায় রাখতে চান, তাদের জন্য টেস্টোস্টেরন একটি অপরিহার্য উপাদান।
তৃতীয়ত, এটি যৌন ইচ্ছা (libido) নিয়ন্ত্রণে রাখে এবং শুক্রাণু উৎপাদনে সহায়তা করে। টেস্টোস্টেরন কমে গেলে অনেক পুরুষ যৌন আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন, আবার অতিরিক্ত বেড়ে গেলে মানসিক অস্থিরতা বা আগ্রাসী আচরণ দেখা দেয়। তাই এই হরমোনের ভারসাম্য বজায় রাখা খুবই জরুরি।
চতুর্থত, টেস্টোস্টেরন মস্তিষ্কের কার্যক্রমেও প্রভাব ফেলে। এটি মনোযোগ, আত্মবিশ্বাস, এবং সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা বাড়ায়। যে পুরুষদের টেস্টোস্টেরন পর্যাপ্ত, তারা সাধারণত বেশি উদ্যমী, আত্মবিশ্বাসী এবং কর্মক্ষম হয়ে থাকেন।
এছাড়া, এই হরমোন শরীরে ফ্যাট বা চর্বির ভারসাম্য বজায় রাখতেও সহায়তা করে। টেস্টোস্টেরন কমে গেলে চর্বি জমতে শুরু করে এবং শরীরের আকৃতি বিকৃত হয়। তাই এটি শুধুমাত্র পেশিশক্তি নয়, বরং শারীরিক গঠন রক্ষায়ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
আরও একটি বড় ভূমিকা হলো — এটি হৃদরোগ প্রতিরোধে সাহায্য করে। পর্যাপ্ত টেস্টোস্টেরন শরীরে রক্ত সঞ্চালন উন্নত করে, রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখে এবং হৃদযন্ত্রের কার্যক্ষমতা বাড়ায়। অনেক গবেষণায় দেখা গেছে, স্বাভাবিক টেস্টোস্টেরন মাত্রা বজায় থাকলে হৃদরোগের ঝুঁকি অনেক কমে যায়।
মানসিক দিক থেকেও এটি গুরুত্বপূর্ণ। টেস্টোস্টেরনের অভাবে অনেক সময় হতাশা, উদ্বেগ বা আত্মবিশ্বাসের ঘাটতি দেখা দেয়। আবার হরমোনের ভারসাম্য ঠিক থাকলে মানুষ বেশি ইতিবাচক, শান্ত ও আত্মনিয়ন্ত্রণে থাকে।
বাংলাদেশের অনেক তরুণ টেস্টোস্টেরন সম্পর্কে শুধু “যৌন হরমোন” হিসেবে জানে, কিন্তু এর আসল কাজের পরিধি অনেক বড়। এটি একাধারে শরীর, মন ও আত্মার শক্তির প্রতীক বলা যায়।
অতএব, টেস্টোস্টেরন হরমোনের কাজ শুধুমাত্র যৌনতা নয়; বরং এটি একজন পুরুষের সামগ্রিক স্বাস্থ্য, মানসিক স্থিতি, আত্মবিশ্বাস, কর্মশক্তি ও জীবনমান নির্ধারণ করে।
ছেলেদের টেস্টোস্টেরন হরমোন বেড়ে গেলে কি হয়?

টেস্টোস্টেরন হরমোনের মাত্রা যদি স্বাভাবিক সীমার চেয়ে বেড়ে যায়, তখন শরীরে বিভিন্ন ধরনের পরিবর্তন দেখা দেয়। শুরুতে এটি শক্তি, উদ্যম বা যৌন ইচ্ছা বাড়িয়ে দেয় বটে, কিন্তু অতিরিক্ত হলে তা শরীর ও মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর হয়ে দাঁড়ায়। ছেলেদের মধ্যে হঠাৎ রাগ, ত্বকের সমস্যা, চুল পড়া, ঘুমের ব্যাঘাত, এমনকি হার্টের সমস্যাও দেখা দিতে পারে। নিচে টেস্টোস্টেরন হরমোন বেড়ে গেলে যে ১০টি পরিবর্তন বা সমস্যা দেখা দিতে পারে, তা বিস্তারিতভাবে তুলে ধরা হলো—
১. অতিরিক্ত আগ্রাসী আচরণ ও রাগ বৃদ্ধি
টেস্টোস্টেরন হরমোনের মাত্রা বেড়ে গেলে মানুষের মস্তিষ্কে এমন কিছু পরিবর্তন ঘটে যা আবেগের নিয়ন্ত্রণে সরাসরি প্রভাব ফেলে। বিশেষ করে মস্তিষ্কের amygdala নামক অংশটি তখন অতি সক্রিয় হয়ে ওঠে, যা ভয়, রাগ এবং উত্তেজনার অনুভূতি তৈরি করে। ফলে একজন পুরুষ স্বাভাবিকের তুলনায় অনেক বেশি আক্রমণাত্মক বা রাগী হয়ে পড়েন। ছোটখাটো বিষয়ে অতিরিক্ত প্রতিক্রিয়া দেখানো, তর্কে জড়িয়ে পড়া বা আত্মনিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলা – এগুলোই প্রথম লক্ষণ।
বাংলাদেশের সমাজে দেখা যায়, অনেক তরুণ জিমে শরীরচর্চা শুরু করার পর টেস্টোস্টেরন বুস্টার বা স্টেরয়েড ব্যবহার করে দ্রুত পেশি বাড়াতে চান। এসব কৃত্রিম উপাদান শরীরে হরমোনের ভারসাম্য নষ্ট করে দেয় এবং মানসিক অস্থিরতা বাড়ায়। এতে করে পরিবার, বন্ধু বা কর্মস্থলের সহকর্মীদের সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ হতে শুরু করে। এমনকি অনেক সময় অল্প কথাতেই রাগ উঠে যায়, যা পরবর্তীতে হিংসাত্মক আচরণে রূপ নিতে পারে।
অতিরিক্ত টেস্টোস্টেরন শরীরে একধরনের মানসিক “উচ্চতা” (high) তৈরি করে, যেন মানুষ নিজেকে সবসময় সঠিক মনে করে। তখন সহানুভূতি বা অন্যের দৃষ্টিভঙ্গি বোঝার ক্ষমতা কমে যায়। এই অবস্থা থেকে ধীরে ধীরে অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস, বেপরোয়া আচরণ এবং মানসিক অস্থিরতা দেখা দেয়। গবেষণায় দেখা গেছে, যেসব পুরুষের টেস্টোস্টেরন অস্বাভাবিকভাবে বেশি, তারা ঝুঁকিপূর্ণ সিদ্ধান্ত বেশি নেন, যেমন মারামারি, অতিরিক্ত মদ্যপান বা বেপরোয়া গাড়ি চালানো।
শুধু তাই নয়, টেস্টোস্টেরনের অতিরিক্ত প্রভাবে মস্তিষ্কে সেরোটোনিন নামের রাসায়নিক পদার্থের ঘাটতি দেখা দেয়, যা শান্ত মনোভাব ধরে রাখতে সাহায্য করে। ফলে রাগান্বিত আচরণ আরও বেড়ে যায়। এ অবস্থায় একজন ব্যক্তি কখনো কখনো নিজের কর্মকাণ্ডে অনুশোচনাও অনুভব করেন না, কারণ তার আবেগের নিয়ন্ত্রণ দুর্বল হয়ে পড়ে।
এই ধরনের মানসিক পরিবর্তন শুধু ব্যক্তির নয়, তার চারপাশের মানুষকেও প্রভাবিত করে। পরিবারে অশান্তি, বন্ধুদের সঙ্গে দূরত্ব, বা কর্মজীবনে সমস্যার সৃষ্টি—সবকিছুই একে একে দেখা দিতে পারে। বিশেষ করে বিবাহিত জীবনে এটি বিরূপ প্রভাব ফেলে, কারণ রাগের কারণে সম্পর্কের মধ্যে দূরত্ব তৈরি হয়।
অতিরিক্ত টেস্টোস্টেরন-জনিত রাগ শুধু মানসিক নয়, শারীরিকভাবেও প্রভাব ফেলে। রাগের সময় শরীরে অ্যাড্রেনালিন বেড়ে যায়, হার্টবিট দ্রুত হয়, রক্তচাপ বাড়ে এবং শরীর সবসময় টানটান থাকে। দীর্ঘমেয়াদে এটি উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ, এমনকি স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়।
২. ত্বকে ব্রণ ও তৈলাক্ততা বৃদ্ধি
টেস্টোস্টেরন হরমোনের মাত্রা বেড়ে গেলে শরীরের ত্বকে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ঘটে, যার মধ্যে সবচেয়ে সাধারণ হলো ব্রণ ও ত্বকের অতিরিক্ত তৈলাক্ততা। এই হরমোন ত্বকের নিচে থাকা সেবেসিয়াস গ্ল্যান্ড বা তৈলগ্রন্থিকে উদ্দীপিত করে, ফলে সেবাম নামের তেল জাতীয় পদার্থের নিঃসরণ বেড়ে যায়। যখন এই তেল অতিরিক্ত মাত্রায় উৎপন্ন হয়, তখন তা রোমকূপের মুখ বন্ধ করে দেয়। ফলে ব্যাকটেরিয়া সহজেই সংক্রমণ ঘটাতে পারে, আর তখনই মুখে, বুকে, পিঠে বা কাঁধে বড় বড় ব্রণ দেখা দেয়।
বাংলাদেশের আবহাওয়া যেহেতু গরম ও আর্দ্র, তাই অতিরিক্ত টেস্টোস্টেরনের প্রভাবে ত্বকের এই সমস্যা আরও প্রকট হয়। ঘাম ও ধুলাবালির সঙ্গে মিশে সেবাম জমে গেলে ব্রণ আরও বেড়ে যায়। অনেক সময় ব্রণ শুধু সৌন্দর্যের সমস্যা নয়, বরং তা ব্যথাযুক্ত ও প্রদাহজনিত আকারও নিতে পারে। তরুণদের মধ্যে এটি আত্মবিশ্বাসের অভাব ও মানসিক অস্বস্তি তৈরি করে।
বিশেষ করে যারা জিমে নিয়মিত ব্যায়াম করেন বা পেশি বাড়ানোর জন্য টেস্টোস্টেরন বুস্টার বা স্টেরয়েড ব্যবহার করেন, তাদের মধ্যে এই সমস্যা অনেক বেশি দেখা যায়। কারণ কৃত্রিমভাবে হরমোনের মাত্রা বাড়ানো ত্বকের প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট করে দেয়। শরীরে পানি কম থাকলে বা খাবারে ভিটামিন ঘাটতি থাকলে ত্বকের অবস্থা আরও খারাপ হয়।
ত্বকের তৈলাক্ততা বেড়ে গেলে শুধুমাত্র ব্রণই নয়, বরং ত্বকে চুলকানি, লালচে ভাব, দাগ এবং ছিদ্র বড় হয়ে যাওয়ার মতো সমস্যা দেখা দেয়। মেয়েদের ক্ষেত্রেও টেস্টোস্টেরন বেড়ে গেলে মুখে ও শরীরে অবাঞ্ছিত লোম এবং ব্রণের সমস্যা দেখা দিতে পারে। তাই এটি কেবল ছেলেদের সমস্যা নয়, বরং হরমোনের ভারসাম্যহীনতা সবার ওপরেই প্রভাব ফেলতে পারে।
ত্বকের এই অবস্থায় অনেকেই অ্যান্টিবায়োটিক বা ক্রিম ব্যবহার করেন, কিন্তু যদি মূল কারণ—অতিরিক্ত টেস্টোস্টেরন—চিকিৎসা না করা হয়, তাহলে সমস্যার সমাধান হয় না। এ কারণে প্রথমে রক্ত পরীক্ষা করে হরমোনের মাত্রা নিশ্চিত করা উচিত।
সঠিক যত্ন নিলে এই সমস্যা অনেকটাই কমানো যায়। প্রতিদিন মুখ পরিষ্কার রাখা, অতিরিক্ত তেলযুক্ত বা ফাস্টফুড পরিহার করা, পর্যাপ্ত পানি পান করা, এবং ঘাম হওয়ার পর ত্বক ধুয়ে ফেলা জরুরি। যাদের জিমে যাওয়ার অভ্যাস আছে, তাদের ব্যায়ামের পরই গোসল করা উচিত যেন ঘাম ও তেল জমে না থাকে।
৩. চুল পড়া ও টাক পড়ার ঝুঁকি
টেস্টোস্টেরন হরমোন শরীরে যখন স্বাভাবিক মাত্রার চেয়ে বেড়ে যায়, তখন এটি ডাইহাইড্রোটেস্টোস্টেরন (DHT) নামের একটি শক্তিশালী হরমোনে রূপান্তরিত হয়। এই DHT চুলের গোড়ার ফলিকল বা Hair Follicle-এ সরাসরি প্রভাব ফেলে। ফলিকল আস্তে আস্তে সংকুচিত হয়ে যায়, ফলে নতুন চুল গজানো বন্ধ হয় এবং পুরনো চুল দ্রুত পড়ে যায়। শুরুতে চুল পাতলা হতে থাকে, পরে তা টাকের দিকে অগ্রসর হয়।
বাংলাদেশে অনেক তরুণ জিমে দ্রুত শরীর গঠন বা পেশি বাড়ানোর জন্য টেস্টোস্টেরন ইনজেকশন বা স্টেরয়েড ব্যবহার করেন। তারা মনে করেন এতে শক্তি ও পুরুষত্ব বাড়বে, কিন্তু জানেন না যে এসব সাপ্লিমেন্ট তাদের চুলের শত্রু হতে পারে। কৃত্রিমভাবে টেস্টোস্টেরন বাড়ালে শরীরে DHT-এর মাত্রাও অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যায়। তখন চুলের ফলিকল স্থায়ীভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে, যার ফলাফল হয় টাক পড়া।
এই সমস্যা শুধু মাথার সামনের অংশেই সীমাবদ্ধ নয়; অনেকের ক্ষেত্রে পুরো মাথার মাঝখান থেকেও চুল উধাও হয়ে যায়। DHT মূলত চুলের বৃদ্ধির চক্রকে ছোট করে দেয়, ফলে চুল আগে থেকেই বিশ্রাম পর্যায়ে চলে যায়। সময়ের সঙ্গে চুলের গোড়া এতটাই দুর্বল হয়ে পড়ে যে পুনরায় চুল গজানোর সম্ভাবনাই হারিয়ে যায়।
চুল পড়া অনেক সময় বংশগতও হতে পারে, কিন্তু যখন টেস্টোস্টেরনের মাত্রা অতিরিক্ত বেড়ে যায়, তখন এই প্রবণতা আরও দ্রুত ঘটে। বিশেষ করে যাদের পরিবারের ইতিহাসে টাক পড়া আছে, তাদের ক্ষেত্রে হরমোনের এই ভারসাম্যহীনতা আরও বেশি ক্ষতি করে।
বাংলাদেশের গরম, ধুলোবালি ও আর্দ্র পরিবেশ চুলের জন্য আলাদা চাপ তৈরি করে। যদি এর সঙ্গে হরমোনের ভারসাম্য নষ্ট হয়, তাহলে চুল পড়া অনেক দ্রুত বেড়ে যায়। অনেক তরুণ প্রথমে হালকাভাবে চুল পড়া লক্ষ্য করেন, পরে যখন টাক দেখা দেয়, তখন বুঝতে পারেন সমস্যার গভীরতা।
অতিরিক্ত টেস্টোস্টেরনের কারণে চুল পড়ার সঙ্গে আরও কিছু লক্ষণও দেখা যায় — যেমন ত্বকের তৈলাক্ততা, ব্রণ, এবং শরীরে অতিরিক্ত ঘাম। এগুলো একসাথে দেখা দিলে বোঝা যায় শরীরে হরমোনের ভারসাম্য নষ্ট হয়েছে।
যদি কারও হঠাৎ করে চুল পড়া বেড়ে যায়, তাহলে প্রথমেই রক্ত পরীক্ষা করে টেস্টোস্টেরন ও DHT-এর মাত্রা জানা উচিত। ডাক্তাররা সাধারণত এই হরমোনের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখতে “Finasteride” বা “Minoxidil” জাতীয় ওষুধ দিয়ে থাকেন, তবে এগুলো কখনোই নিজের সিদ্ধান্তে নেওয়া উচিত নয়। কারণ ভুল ডোজ বা ভুল ব্যবহারে শরীরে অন্যান্য পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে।
চুল পড়া রোধে প্রাকৃতিক যত্নও গুরুত্বপূর্ণ। যেমন—পর্যাপ্ত পানি পান, জিঙ্ক ও ভিটামিন ই সমৃদ্ধ খাবার খাওয়া, ধূমপান-অ্যালকোহল এড়িয়ে চলা, এবং নিয়মিত হালকা ম্যাসাজ করা। তাছাড়া, মানসিক চাপ কমানোও জরুরি, কারণ স্ট্রেসও হরমোনের ভারসাম্য নষ্ট করতে পারে।
চুল শুধু সৌন্দর্যের প্রতীক নয়, এটি একজন মানুষের আত্মবিশ্বাসেরও অংশ। তাই টেস্টোস্টেরন বেড়ে গেলে বা হঠাৎ চুল পড়া শুরু হলে সেটিকে হালকাভাবে না নিয়ে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া উচিত।
অতএব, অতিরিক্ত টেস্টোস্টেরন শরীরের শক্তি বাড়ালেও মাথার চুলের জন্য বিপদ ডেকে আনে। হরমোনের ভারসাম্য ঠিক না থাকলে যত দামি শ্যাম্পু বা তেলই ব্যবহার করা হোক না কেন, সমস্যার মূল কারণ দূর হয় না। তাই প্রাকৃতিক উপায়ে হরমোন নিয়ন্ত্রণ ও চিকিৎসকের পরামর্শই হতে পারে সবচেয়ে কার্যকর সমাধান।
৪. ঘুমের সমস্যা ও অনিদ্রা
টেস্টোস্টেরন হরমোনের মাত্রা বেড়ে গেলে শরীরের প্রাকৃতিক ঘুমের ছন্দে বড় ধরনের ব্যাঘাত ঘটে। সাধারণভাবে রাতে ঘুমানোর সময় শরীরের বিভিন্ন হরমোনের মাত্রা একটি নির্দিষ্ট ভারসাম্যে থাকে, যা ঘুমের গভীরতা ও মান নির্ধারণ করে। কিন্তু যখন টেস্টোস্টেরন অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যায়, তখন এই ভারসাম্য নষ্ট হয়। ফলে ঘুম আসতে দেরি হয়, মাঝরাতে ঘুম ভেঙে যায়, কিংবা ভোরের আগে ঘুম কেটে যায়।
এই অবস্থায় শরীর অস্থির লাগে, মন শান্ত থাকে না, আর মাথা ভার হয়ে যায়। অনিদ্রা বা ঘুমের ব্যাঘাতের কারণে পরদিন সারাদিন ক্লান্তি, মনোযোগের ঘাটতি ও মাথাব্যথা দেখা দেয়। অনেক পুরুষ বুঝতেই পারেন না যে তাদের ঘুমের সমস্যা আসলে হরমোনজনিত হতে পারে।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, টেস্টোস্টেরন বেড়ে গেলে শরীরের মেলাটোনিন (Melatonin) নামের ঘুম-নিয়ন্ত্রক হরমোনের নিঃসরণ কমে যায়। এই মেলাটোনিনই রাতে শরীরকে বিশ্রামের জন্য প্রস্তুত করে। যখন এটি কমে যায়, তখন মানুষ স্বাভাবিকভাবে ঘুমাতে পারে না। এছাড়া, অতিরিক্ত টেস্টোস্টেরনের কারণে শরীরে শক্তি বেড়ে যায়, ফলে মন ও দেহ দুটোই অস্থির থাকে। এমনকি ঘুমের মধ্যেও কেউ কেউ ঘামতে থাকে বা দুঃস্বপ্ন দেখে।
বাংলাদেশের অনেক তরুণ যারা জিমে পেশি বাড়াতে টেস্টোস্টেরন বুস্টার ব্যবহার করেন, তারা প্রায়ই অভিযোগ করেন যে রাতে ঘুম আসে না বা বারবার ঘুম ভেঙে যায়। কারণ কৃত্রিম হরমোন শরীরের প্রাকৃতিক ঘুম-চক্রকে ব্যাহত করে। অনেকে আবার শক্তি ধরে রাখতে অতিরিক্ত কফি, এনার্জি ড্রিঙ্ক বা প্রোটিন সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ করেন, যা সমস্যাকে আরও বাড়িয়ে তোলে।
অনিদ্রার ফলে শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতাও দুর্বল হয়ে পড়ে। ঘুমের সময় শরীর কোষ মেরামত করে, কিন্তু ঘুম ঠিকমতো না হলে ক্লান্তি জমে থাকে, মানসিক চাপ বাড়ে এবং হরমোনের ভারসাম্য আরও খারাপ হয়। এর ফলে “একটি দুষ্টচক্র” তৈরি হয়—হরমোন বেড়ে গিয়ে ঘুম নষ্ট করে, আর ঘুমের অভাবে হরমোন আরও অনিয়ন্ত্রিত হয়।
মনস্তাত্ত্বিক দিক থেকেও এই সমস্যা গভীর। ঘুমের অভাবে রাগ, উত্তেজনা, অস্থিরতা এবং সিদ্ধান্ত নেওয়ার অক্ষমতা দেখা দেয়। অনিদ্রা দীর্ঘস্থায়ী হলে ডিপ্রেশন বা উদ্বেগজনিত সমস্যা দেখা দিতে পারে। অনেক সময় ঘুমের ওষুধ খেয়ে মানুষ সাময়িক সমাধান পায়, কিন্তু মূল কারণ (অতিরিক্ত টেস্টোস্টেরন) ঠিক না করলে তা স্থায়ী হয় না।
সমাধানের জন্য প্রথমে হরমোনের মাত্রা পরীক্ষা করে দেখা জরুরি। যদি দেখা যায় টেস্টোস্টেরন স্বাভাবিক সীমার উপরে, তাহলে চিকিৎসকের পরামর্শে তা নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে। পাশাপাশি, রাতে মোবাইল বা স্ক্রিন ব্যবহার কমানো, ঘুমানোর আগে ভারী খাবার না খাওয়া, ধ্যান বা মেডিটেশন করা, এবং প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময়ে ঘুমানোর অভ্যাস তৈরি করা উচিত।
বাংলাদেশের তরুণদের মধ্যে ঘুমের সমস্যা ক্রমেই বাড়ছে, যার পেছনে কাজ করছে চাপযুক্ত জীবন, অনিয়মিত সময়সূচি এবং হরমোনের অসামঞ্জস্য। অনেকেই একে সাধারণ বিষয় মনে করে অবহেলা করেন, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে এটি হৃদরোগ, স্থূলতা ও মানসিক অবসাদের ঝুঁকি বাড়ায়।
অতএব, পর্যাপ্ত ও গভীর ঘুম শুধু বিশ্রাম নয়, এটি শরীরের হরমোন ভারসাম্য রক্ষার একটি গুরুত্বপূর্ণ উপায়। টেস্টোস্টেরন বেড়ে গেলে যদি ঘুমে সমস্যা দেখা দেয়, তবে দ্রুত তা নিয়ন্ত্রণে নেওয়া প্রয়োজন—কারণ ভালো ঘুম মানেই সুস্থ শরীর ও স্থিতিশীল মন।
৫. হৃদরোগ ও উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি
অতিরিক্ত টেস্টোস্টেরন হরমোন শরীরে অনেক শারীরবৃত্তীয় পরিবর্তন আনে, যার মধ্যে অন্যতম হলো হৃদরোগ ও উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি বৃদ্ধি। সাধারণভাবে টেস্টোস্টেরন পুরুষদের শরীরে শক্তি, পেশি বৃদ্ধি এবং রক্ত সঞ্চালনে সহায়তা করে, কিন্তু যখন এর মাত্রা স্বাভাবিক সীমা ছাড়িয়ে যায়, তখন সেটি আশীর্বাদ না হয়ে অভিশাপে পরিণত হয়।
যখন টেস্টোস্টেরন অতিরিক্ত হয়, তখন শরীরের রক্ত ঘন হয়ে যায় (blood viscosity বৃদ্ধি পায়)। এর ফলে রক্তনালীগুলোতে চাপ বেড়ে যায়, আর এই চাপই ধীরে ধীরে উচ্চ রক্তচাপে পরিণত হয়। ঘন রক্ত সহজে চলাচল করতে পারে না, ফলে হৃদপিণ্ডকে বেশি শক্তি প্রয়োগ করে রক্ত পাম্প করতে হয়। দীর্ঘদিন এমন অবস্থা চললে হৃদপিণ্ড ক্লান্ত হয়ে পড়ে এবং হার্ট অ্যাটাক বা স্ট্রোকের ঝুঁকি তৈরি হয়।
বাংলাদেশে অনেক তরুণ জিমে পেশি গঠনের জন্য টেস্টোস্টেরন ইনজেকশন বা স্টেরয়েড ব্যবহার করেন। শুরুতে এটি তাদের শরীরকে আকর্ষণীয় করে তোলে, কিন্তু ভেতরে ভেতরে হৃদযন্ত্রে বিপজ্জনক প্রভাব ফেলে। কারণ এই কৃত্রিম হরমোন শরীরে কোলেস্টেরলের ভারসাম্য নষ্ট করে দেয়—ভালো কোলেস্টেরল (HDL) কমে যায় এবং খারাপ কোলেস্টেরল (LDL) বেড়ে যায়। ফলস্বরূপ ধমনীগুলোতে চর্বি জমে এবং রক্তপ্রবাহে বাধা সৃষ্টি হয়।
অতিরিক্ত টেস্টোস্টেরনের প্রভাবে রক্তচাপ বেড়ে গেলে মাথাব্যথা, চোখে ঝাপসা দেখা, বুক ধড়ফড় করা বা অল্প হাঁটলেই শ্বাসকষ্টের মতো উপসর্গ দেখা দিতে পারে। অনেকে আবার মনে করেন এগুলো সাময়িক সমস্যা, কিন্তু সময়মতো চিকিৎসা না নিলে তা প্রাণঘাতী হতে পারে।
গবেষণায় দেখা গেছে, যেসব পুরুষ নিয়মিত স্টেরয়েড জাতীয় টেস্টোস্টেরন বুস্টার ব্যবহার করেন, তাদের মধ্যে হৃদরোগের ঝুঁকি সাধারণ পুরুষদের তুলনায় ৪ থেকে ৫ গুণ বেশি। এদের মধ্যে অনেকের বয়স ৩০ বছরেরও কম, অথচ হঠাৎ হার্ট অ্যাটাকের মতো ঘটনা ঘটে। এটি শুধু শারীরিক নয়, মানসিক দিক থেকেও ভয়াবহ—কারণ হরমোনের ভারসাম্য নষ্ট হলে শরীরের স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া বিঘ্নিত হয়।
বাংলাদেশে আজকাল তরুণদের মধ্যে “ফিটনেস” শব্দটি খুব জনপ্রিয়, কিন্তু অনেকেই বুঝতে পারেন না যে অতি দ্রুত ফলাফল পেতে গিয়ে তাঁরা নিজের হৃদযন্ত্রকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছেন। শরীরচর্চা ভালো, কিন্তু হরমোনের অপব্যবহার কখনোই নিরাপদ নয়।
অতিরিক্ত টেস্টোস্টেরন শুধু রক্তচাপ নয়, হৃদপিণ্ডের গঠনেও পরিবর্তন আনে। হৃদপিণ্ডের পেশি মোটা হয়ে যায় (Left Ventricular Hypertrophy), ফলে রক্ত সঞ্চালন স্বাভাবিকভাবে হয় না। এর ফলে অক্সিজেনের সরবরাহ কমে যায়, যা ধীরে ধীরে হৃদপিণ্ডের কার্যক্ষমতা কমিয়ে দেয়।
৬. যৌন ইচ্ছা অতিরিক্ত বৃদ্ধি ও অস্থিরতা
যখন টেস্টোস্টেরনের মাত্রা স্বাভাবিক সীমার চেয়ে বেশি হয়ে যায়, তখন এটি সরাসরি যৌন ইচ্ছা (libido) ও মানসিক অস্থিরতার ওপর প্রভাব ফেলে। প্রথমদিকে এটি স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি যৌন আকাঙ্ক্ষা তৈরি করে, যা কিছু ক্ষেত্রে আনন্দদায়ক মনে হলেও দীর্ঘমেয়াদে সমস্যা সৃষ্টি করে। অতিরিক্ত যৌন ইচ্ছা মানসিক চাপ, উদ্বেগ, এবং আচরণগত অস্থিরতা বৃদ্ধি করতে পারে।
বাংলাদেশের অনেক তরুণ যুবকরা ফিটনেস বা শরীরচর্চার জন্য হরমোন বুস্টার ব্যবহার করেন। এই হরমোনের মাত্রা বেড়ে গেলে শরীর ও মস্তিষ্কে একটি “high energy” অবস্থার সৃষ্টি হয়। এর ফলে ব্যক্তি অবাস্তব যৌন চিন্তা, অযাচিত উত্তেজনা, এবং কখনো কখনো অপ্রয়োজনীয় যৌন আচরণ প্রদর্শন করতে শুরু করেন। এটি পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে সমস্যা তৈরি করে।
অতিরিক্ত টেস্টোস্টেরনের কারণে মনস্তাত্ত্বিক ভারসাম্য নষ্ট হয়। মানুষ সহজেই চঞ্চল, অস্থির বা হঠাৎ রাগান্বিত হতে পারে। যৌন ইচ্ছার সঙ্গে এই অস্থিরতা মিলিত হলে মানসিক চাপ ও হতাশা তৈরি হতে পারে। কখনো কেউ নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না, যার ফলে তারা হঠাৎ ঝুঁকিপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেন বা অনৈতিক আচরণ করতে পারেন।
এই সমস্যার সঙ্গে ঘুমের ব্যাঘাতও যুক্ত হয়। কারণ হরমোনের অতিরিক্ত ওঠানামা রাতে ঘুমকে প্রভাবিত করে, আর ঘুম কম হলে যৌন ইচ্ছা নিয়ন্ত্রণে আরও সমস্যা তৈরি হয়। এছাড়া, অতিরিক্ত হরমোন মানসিক চাপ এবং উদ্বেগ বৃদ্ধি করে, যা যৌন জীবনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
দীর্ঘমেয়াদে, এই পরিস্থিতি ব্যক্তি-নিজের জন্যও হানিকারক হয়ে ওঠে। অতিরিক্ত যৌন ইচ্ছার কারণে সম্পর্কের মধ্যে দূরত্ব তৈরি হয়, আত্মবিশ্বাস কমে যায় এবং সামাজিক আচরণে অসন্তোষ দেখা দেয়। এটি প্রমাণ করে যে, শুধু যৌন শক্তি বৃদ্ধি নয়, হরমোনের ভারসাম্য বজায় রাখা সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ।
সমাধানের জন্য প্রথমে রক্ত পরীক্ষা করে হরমোনের মাত্রা নির্ধারণ করা উচিত। চিকিৎসকের পরামর্শে হরমোন নিয়ন্ত্রণের উপায় গ্রহণ করা যেতে পারে। পাশাপাশি ধ্যান, নিয়মিত ব্যায়াম, পর্যাপ্ত ঘুম এবং মানসিক চাপ কমানো জরুরি। খাদ্যাভ্যাসেও ভারসাম্য রাখতে হবে—যেমন পর্যাপ্ত প্রোটিন, ভিটামিন এবং মিনারেল গ্রহণ।
সর্বোপরি, টেস্টোস্টেরনের অতিরিক্ত বৃদ্ধি স্বাভাবিক শক্তি ও যৌন ইচ্ছা বাড়াতে পারে, কিন্তু এটি যদি নিয়ন্ত্রণে না রাখা হয়, তা মানসিক, শারীরিক এবং সামাজিক জীবনে সমস্যা তৈরি করে। তাই ভারসাম্য বজায় রাখা, সচেতন থাকা এবং চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া অপরিহার্য।
৭. শুক্রাণুর মান ও পরিমাণ কমে যাওয়া
অতিরিক্ত টেস্টোস্টেরন হরমোন শরীরে স্বাভাবিক প্রজনন প্রক্রিয়ায় ব্যাঘাত ঘটায়। অনেকেই মনে করেন, হরমোন বেশি হলে যৌন ক্ষমতা ও প্রজননশক্তি বাড়বে, কিন্তু বাস্তবে এটি উল্টো প্রভাব ফেলে। যখন শরীরে বাইরের উৎস থেকে অতিরিক্ত টেস্টোস্টেরন আসে (যেমন ইনজেকশন বা সাপ্লিমেন্টের মাধ্যমে), তখন শরীর মনে করে পর্যাপ্ত হরমোন আছে। ফলস্বরূপ, স্বাভাবিক প্রাকৃতিক উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়, এবং শুক্রাণুর (Sperm) মান ও পরিমাণ কমে যায়।
শুক্রাণুর মান ও পরিমাণ কমে গেলে স্বাভাবিকভাবে প্রজননক্ষমতাও হ্রাস পায়। এমন পুরুষেরা দীর্ঘদিন সন্তান ধারণে সমস্যায় ভোগেন। এটি সাধারণত লক্ষ্য করা যায় যে, যারা স্টেরয়েড বা টেস্টোস্টেরন বুস্টার ব্যবহার করে শরীর গঠন করছেন, তাদের মধ্যে এই ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি। বিশেষ করে ২০-৩৫ বছর বয়সী তরুণদের ক্ষেত্রে, যাদের প্রজনন ক্ষমতা ভবিষ্যতে গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে, এটি বড় সমস্যা তৈরি করে।
এটি শুধুমাত্র শুক্রাণুর সংখ্যা কমায় না, বরং মানও প্রভাবিত করে। DHT ও অতিরিক্ত টেস্টোস্টেরনের প্রভাবে শুক্রাণুর গঠন দুর্বল হয়, যার ফলে এটি এগিয়ে যেতে বা নিষিক্ত করতে সক্ষম হয় না। এই কারণে প্রজননের সম্ভাবনা হ্রাস পায়।
বাংলাদেশে এই সমস্যা নিয়ে সচেতনতা কম। অনেক তরুণ ফিটনেস বা শরীরচর্চার জন্য হরমোন ব্যবহার করেন, কিন্তু এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া বোঝেন না। ফলে পরবর্তীতে প্রজননক্ষমতা হ্রাসে সমস্যা দেখা দেয়। প্রয়োজন হয় নিয়মিত রক্ত পরীক্ষা, হরমোনের মাত্রা নিরীক্ষণ এবং প্রয়োজনে চিকিৎসকের পরামর্শে ওষুধ বা প্রাকৃতিক উপায় গ্রহণ।
সুস্থ শুক্রাণু ও প্রজনন ক্ষমতা বজায় রাখতে খাবার ও জীবনধারাও গুরুত্বপূর্ণ। প্রোটিন, জিঙ্ক, ভিটামিন ই ও ওমেগা-৩ সমৃদ্ধ খাদ্য শুক্রাণুর গুণগত মান বজায় রাখতে সাহায্য করে। পর্যাপ্ত ঘুম, মানসিক চাপ কমানো এবং ধূমপান, মদ্যপান পরিহারও প্রজননশক্তি রক্ষার জন্য অপরিহার্য।
পরিশেষে বলা যায়, টেস্টোস্টেরন অতিরিক্ত বৃদ্ধি প্রজননশক্তির জন্য হুমকি হতে পারে। তাই এটি সচেতনভাবে নিয়ন্ত্রণ করা এবং চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ব্যবহৃত ওষুধ বা সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ভারসাম্যহীন হরমোন স্বাভাবিক যৌন ক্ষমতা ও প্রজননক্ষমতাকে দীর্ঘমেয়াদে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে।
৮. লিভার ও কিডনির ক্ষতি
অতিরিক্ত টেস্টোস্টেরন হরমোন শরীরের লিভার ও কিডনির ওপর উল্লেখযোগ্য চাপ সৃষ্টি করে। লিভার হলো দেহের প্রধান ডিটক্সিফিকেশন অঙ্গ, যা শরীরের বিষাক্ত পদার্থ দূর করে। যখন হরমোনের মাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি হয়, তখন লিভারকে অতিরিক্ত কাজ করতে হয়। বিশেষ করে টেস্টোস্টেরন ইনজেকশন বা বুস্টার ব্যবহার করলে লিভারের কোষে বিষাক্ত পদার্থ জমে যায়, যা দীর্ঘমেয়াদে লিভার সিরোসিস বা ফ্যাটি লিভারের মতো সমস্যা তৈরি করতে পারে।
কিডনিও একইভাবে প্রভাবিত হয়। কিডনি শরীরের রক্ত শোধন ও ফ্লুইড ব্যালেন্স বজায় রাখে। অতিরিক্ত হরমোনের কারণে রক্তে চাপ বেড়ে যায়, পেশি ও রক্তনালীতে পরিবর্তন আসে। এতে কিডনির ফিল্টারিং ক্ষমতা দুর্বল হয়ে যায়। দীর্ঘমেয়াদে কিডনি ফেইলিউরের ঝুঁকি বেড়ে যায়।
বাংলাদেশে ফিটনেসের জন্য হরমোন নেওয়া তরুণদের মধ্যে এই সমস্যা বেশি দেখা যায়। শুরুতে শরীর চাঙ্গা ও শক্তিশালী মনে হলেও, অভ্যন্তরীণ অঙ্গগুলো ধীরে ধীরে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অনেকেই বুঝতে পারেন না যে লিভার বা কিডনির ক্ষতি হয়ে গেলে পুনরুদ্ধার করা কঠিন।
লিভার ও কিডনির এই সমস্যা প্রাথমিক পর্যায়ে লক্ষণহীন থাকতে পারে। তবে কিছু লক্ষণ দেখা দিলে সতর্ক হওয়া উচিত, যেমন: ত্বকের হলদেটে ভাব, চোখের পলক হলুদ হয়ে যাওয়া, শরীরে ফোলাভাব, মল বা প্রস্রাবে অস্বাভাবিক রঙ বা ঘ্রাণ। এই সব লক্ষণগুলো দেখা দিলে অবিলম্বে ডাক্তার বা নেফ্রোলজিস্টের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
প্রতিরোধমূলক পদক্ষেপ হিসেবে হরমোন গ্রহণের আগে ও পরে নিয়মিত রক্ত পরীক্ষা, লিভার ফাংশন টেস্ট (LFT) এবং কিডনি ফাংশন টেস্ট (KFT) করা অত্যন্ত জরুরি। এছাড়া, হালকা ব্যায়াম, পর্যাপ্ত পানি পান, ভিটামিন সমৃদ্ধ খাদ্য এবং অ্যালকোহল ও ধূমপান পরিহার করা দরকার।
প্রাকৃতিক উপায়ে হরমোন নিয়ন্ত্রণও গুরুত্বপূর্ণ। ঘুম ঠিক রাখা, মানসিক চাপ কমানো এবং সুষম খাদ্য গ্রহণ লিভার ও কিডনিকে সুস্থ রাখে। স্টেরয়েড বা ইনজেকশন ব্যবহার করার আগে সবসময় চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
অতএব, অতিরিক্ত টেস্টোস্টেরন শরীরের শক্তি ও পেশি বাড়াতে সাহায্য করলেও, লিভার ও কিডনির জন্য এটি বিপদজনক হতে পারে। ভারসাম্যহীন হরমোন দীর্ঘমেয়াদে গোপনভাবে শরীরের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গগুলোকে ক্ষতিগ্রস্ত করে, যা অবহেলার পরিণতি মারাত্মক হতে পারে।
৯. ঘাম, শরীরের দুর্গন্ধ ও ত্বকের রুক্ষতা
অতিরিক্ত টেস্টোস্টেরন হরমোন শরীরের সুইট গ্রন্থি (sweat glands) এবং ত্বকের তৈলগ্রন্থি (sebaceous glands) সক্রিয়তা বাড়িয়ে দেয়। ফলে শরীর থেকে ঘামের নিঃসরণ বেড়ে যায়। সাধারণভাবে ঘাম শরীরকে ঠাণ্ডা রাখে, কিন্তু অতিরিক্ত ঘাম দুর্গন্ধ এবং ত্বকের অস্বস্তি সৃষ্টি করতে পারে। এই অবস্থায় শরীরের ত্বক রুক্ষ হয়ে যায় এবং সহজেই সংক্রমণের ঝুঁকি তৈরি হয়।
বাংলাদেশে গরম ও আর্দ্র আবহাওয়া এই সমস্যাকে আরও তীব্র করে। যারা অতিরিক্ত হরমোন বা স্টেরয়েড ব্যবহার করেন, তাদের ক্ষেত্রে ঘাম ও দুর্গন্ধ স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি হয়। শুধু ঘাম নয়, অতিরিক্ত তৈলাক্ত ত্বকের কারণে ব্রণ, ফোলাভাব এবং ত্বকে দাগও দেখা দিতে পারে। ত্বক চটচটে, রুক্ষ এবং অস্বাস্থ্যকর মনে হয়।
শরীর থেকে দুর্গন্ধ আসে যখন ঘাম ব্যাকটেরিয়ার সঙ্গে মিশে। টেস্টোস্টেরনের কারণে ঘামের পরিমাণ বেড়ে গেলে এই ব্যাকটেরিয়ার বৃদ্ধিও দ্রুত হয়। ফলে শরীরের দুর্গন্ধ নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে যায়। অনেক সময় সাধারণ সাবান বা ডিওডোরেন্ট ব্যবহার করেও সমস্যার সমাধান হয় না।
ঘাম ও ত্বকের রুক্ষতার কারণে সামাজিক ও মানসিক অস্বস্তি দেখা দেয়। ব্যক্তি আত্মবিশ্বাস হারাতে পারেন, বিশেষ করে যদি তার পেশাগত বা সামাজিক জীবনে মানুষের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ থাকে। এটি মানসিক চাপও বাড়ায়, যা আবার হরমোনের ভারসাম্যকে আরও প্রভাবিত করে।
সমাধানের জন্য নিয়মিত গোসল, হালকা এবং শ্বাসপ্রশ্বাসযোগ্য পোশাক পরা, এবং ত্বকের পরিচর্যা অপরিহার্য। এছাড়া, পানি পর্যাপ্তভাবে পান করা এবং স্বাস্থ্যকর খাদ্য গ্রহণ ঘামের মাত্রা ও ত্বকের স্বাস্থ্য নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। স্টেরয়েড বা অতিরিক্ত টেস্টোস্টেরন ব্যবহার করলে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
প্রাকৃতিকভাবে ত্বককে সুস্থ রাখতে, ভিটামিন ও মিনারেল সমৃদ্ধ খাবার, পর্যাপ্ত ঘুম, ধ্যান বা মেডিটেশন ও মানসিক চাপ কমানো জরুরি। যদি সময়মতো ব্যবস্থা না নেওয়া হয়, তাহলে দীর্ঘমেয়াদে ত্বক স্থায়ীভাবে রুক্ষ বা সংক্রমণের প্রতি সংবেদনশীল হয়ে যায়।
অতএব, টেস্টোস্টেরনের অতিরিক্ত বৃদ্ধি শরীরের ঘাম, দুর্গন্ধ এবং ত্বকের স্বাস্থ্যকে খারাপ করে। ভারসাম্যহীন হরমোন কেবল শক্তি বা পেশি বৃদ্ধি করে না, বরং দৈনন্দিন জীবন ও আত্মবিশ্বাসের ওপরও নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
১০. মানসিক অস্থিরতা ও ডিপ্রেশন
টেস্টোস্টেরন হরমোনের মাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি হলে শুধুমাত্র শারীরিক পরিবর্তনই হয় না, মানসিক অবস্থা ও আবেগের ওপরও বড় ধরনের প্রভাব পড়ে। অতিরিক্ত হরমোন মস্তিষ্কের নিউরোট্রান্সমিটার ব্যালান্সকে পরিবর্তন করে, বিশেষ করে সেরোটোনিন ও ডোপামিনের মাত্রা। এ কারণে মানসিক অস্থিরতা, হতাশা এবং কখনো কখনো ডিপ্রেশনের ঝুঁকি বেড়ে যায়।
বাংলাদেশে ফিটনেস বা শরীরচর্চার জন্য হরমোন বুস্টার ব্যবহার করা তরুণদের মধ্যে এই সমস্যা লক্ষ্য করা গেছে। শারীরিক শক্তি বেড়ে গেলেও মনের শান্তি কমে যায়। হঠাৎ রাগ, উদ্বেগ, অস্থিরতা বা অপ্রত্যাশিত মানসিক প্রতিক্রিয়া – এগুলো সাধারণ লক্ষণ। কেউ কেউ নিজের আচরণ নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন না, যার ফলে পারিবারিক ও সামাজিক সম্পর্ক খারাপ হতে শুরু করে।
অতিরিক্ত টেস্টোস্টেরনের প্রভাবে ঘুমের ব্যাঘাত, অতিরিক্ত যৌন ইচ্ছা এবং হঠাৎ রাগ বা উত্তেজনা একত্রে মানসিক চাপ তৈরি করে। দীর্ঘমেয়াদে এটি ডিপ্রেশনের দিকে ধাবিত করে। ডিপ্রেশন শুধু মনকে প্রভাবিত করে না, বরং শরীরেও ক্লান্তি, মাথাব্যথা, হজমের সমস্যা ও রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতার হ্রাস ঘটায়।
অনেকে এই সমস্যা উপেক্ষা করেন, কিন্তু সময়মতো চিকিৎসা না নিলে মানসিক সমস্যা গভীর হয়। বাংলাদেশে মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতি সচেতনতা কম থাকায় তরুণরা চিকিৎসার পরিবর্তে একা চেষ্টা করতে গিয়ে সমস্যার মাত্রা বাড়িয়ে ফেলেন। সঠিক হেলথ চেকআপ এবং হরমোনের ভারসাম্য ঠিক করার মাধ্যমে এই সমস্যা অনেকটাই নিয়ন্ত্রণ করা যায়।
সমাধানের জন্য ধ্যান, নিয়মিত ব্যায়াম, পর্যাপ্ত ঘুম, স্বাস্থ্যকর খাদ্য এবং সামাজিক সমর্থন অপরিহার্য। প্রয়োজনে মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ বা মনোচিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ নেওয়া উচিত। হরমোন নিয়ন্ত্রণের জন্য ডাক্তার কখনও টেস্টোস্টেরন নিয়ন্ত্রণকারী ওষুধ দিতে পারেন।
অতএব, টেস্টোস্টেরনের অতিরিক্ত বৃদ্ধি শুধুমাত্র শারীরিক নয়, মানসিক স্বাস্থ্যের জন্যও বিপজ্জনক। ভারসাম্যহীন হরমোন দীর্ঘমেয়াদে ডিপ্রেশন, উদ্বেগ এবং মানসিক অস্থিরতা তৈরি করতে পারে। তাই সচেতন থাকা, নিয়মিত পরীক্ষা করা এবং প্রয়োজনে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
টেস্টোস্টেরন হরমোন কমে যায় কেন?

টেস্টোস্টেরন হরমোন স্বাভাবিকভাবে পুরুষদের শরীরে পেশি বৃদ্ধি, শক্তি, যৌন ইচ্ছা ও হাড়ের ঘনত্ব বজায় রাখে। তবে কিছু কারণে এর মাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে কমে যেতে পারে। বাংলাদেশে এবং অন্যান্য অঞ্চলেও এটি একটি সাধারণ সমস্যা হিসেবে দেখা যায়, বিশেষ করে ৩০ বছরের পরে। হরমোন কমে যাওয়ার পেছনে প্রধান কারণগুলো হলো—
১. বয়স বৃদ্ধির প্রভাব: বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পুরুষদের শরীরে টেস্টোস্টেরন উৎপাদন ধীরে ধীরে হ্রাস পায়। সাধারণত ৩০ বছরের পর প্রতি বছর প্রায় ১–২% হ্রাস ঘটে। এ কারণে পেশির শক্তি কমে, হাড় দুর্বল হয় এবং যৌন ইচ্ছা হ্রাস পায়।
২. অতিরিক্ত ওজন ও স্থূলতা: যাদের শরীরে অতিরিক্ত চর্বি আছে, তারা প্রায়ই টেস্টোস্টেরন হরমোন কমে যাওয়ার সমস্যায় ভুগেন। বিশেষ করে পেটের চারপাশে চর্বি হরমোনের ভারসাম্য নষ্ট করে।
৩. মানসিক চাপ ও উদ্বেগ: দীর্ঘদিন মানসিক চাপ, দুশ্চিন্তা ও উদ্বেগ টেস্টোস্টেরন উৎপাদনকে প্রভাবিত করে। স্ট্রেস হরমোন কর্টিসল বৃদ্ধি করে, যা টেস্টোস্টেরন কমিয়ে দেয়।
৪. অপ্রতুল ঘুম: ঘুমের সময় শরীর হরমোন উৎপাদন করে। ঘুমের অভাব বা অনিয়মিত ঘুম টেস্টোস্টেরন কমিয়ে দেয় এবং সারাদিন ক্লান্তি, মনোযোগের অভাব ও মানসিক চাপ তৈরি করে।
৫. অস্বাস্থ্যকর জীবনধারা: অতিরিক্ত ধূমপান, অ্যালকোহল গ্রহণ, অনিয়মিত খাদ্যাভ্যাস, এবং শারীরিক ব্যায়ামের অভাব হরমোনের ভারসাম্য নষ্ট করে।
৬. জিনগত কারণে হরমোন কমে যাওয়া: পরিবারের ইতিহাসে যাদের টেস্টোস্টেরন কমার প্রবণতা আছে, তাদের ক্ষেত্রে এটি আরও তাড়াতাড়ি হতে পারে।
৭. চিকিৎসা ও ওষুধের প্রভাব: কিছু ওষুধ, যেমন স্টেরয়েড, ক্যান্সার চিকিৎসার ওষুধ বা কিছু দীর্ঘমেয়াদী রোগের ওষুধ, টেস্টোস্টেরন উৎপাদন কমাতে পারে।
৮. ক্রনিক অসুস্থতা: ডায়াবেটিস, কিডনি সমস্যা, লিভারের রোগ বা হৃদরোগের মতো দীর্ঘমেয়াদী সমস্যা টেস্টোস্টেরনের মাত্রা কমাতে পারে।
৯. হরমোন উৎপাদনকারী অঙ্গের সমস্যা: পুরুষদের অণ্ডকোষ বা পিটুইটারি গ্রন্থি ঠিকমতো কাজ না করলে টেস্টোস্টেরন কমে যায়।
১০. অতিরিক্ত ফিটনেস বা স্টেরয়েডের প্রভাব: অতি মাত্রায় পেশি বাড়ানোর জন্য নেওয়া কৃত্রিম হরমোন শরীরের স্বাভাবিক টেস্টোস্টেরন উৎপাদনকে বন্ধ করে দিতে পারে।
টেস্টোস্টেরন কমে গেলে শরীরের বিভিন্ন ক্ষেত্রে পরিবর্তন দেখা দেয়—পেশির শক্তি কমে, হাড় দুর্বল হয়, যৌন ইচ্ছা হ্রাস পায়, মানসিক চাপ ও ডিপ্রেশন বাড়ে। তাই সময়মতো হরমোন পরীক্ষা করা এবং চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী পদক্ষেপ নেওয়া গুরুত্বপূর্ণ।
প্রাকৃতিকভাবে হরমোন বাড়াতে পারে—নিয়মিত ব্যায়াম, সুষম খাদ্য, পর্যাপ্ত ঘুম, মানসিক চাপ কমানো এবং ওজন নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে। এছাড়া, চিকিৎসকের পরামর্শে প্রয়োজনে হরমোন থেরাপি গ্রহণ করা যেতে পারে।
বহুল জিজ্ঞাসিত প্রশ্ন ও উত্তর সমূহ
ছেলেদের টেস্টোস্টেরন হরমোন বেড়ে গেলে কি হয়?এই বিষয়ে আপনার মনে বেশ কয়েকটি প্রশ্ন উঁকি দিচ্ছে? তাহলে চলুন জেনে নেই সেই সকল প্রশ্ন ও উত্তরগুলো-
টেস্টোস্টেরন হরমোন অতিরিক্ত বেড়ে গেলে কি সমস্যা হতে পারে?
অতিরিক্ত টেস্টোস্টেরন হরমোন শরীরে বিভিন্ন সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। এর মধ্যে অন্যতম হলো আগ্রাসী আচরণ, রাগ বৃদ্ধি, ঘুমের সমস্যা, ব্রণ, চুল পড়া, হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ এবং মানসিক অস্থিরতা। দীর্ঘমেয়াদে এটি প্রজনন ক্ষমতা হ্রাস এবং লিভার ও কিডনির ক্ষতির কারণও হতে পারে।
টেস্টোস্টেরন কমে গেলে শরীরে কি পরিবর্তন আসে এবং কিভাবে এটি ঠিক করা যায়?
টেস্টোস্টেরন কমে গেলে পেশি শক্তি হ্রাস পায়, যৌন ইচ্ছা কমে যায়, হাড় দুর্বল হয় এবং মানসিক চাপ ও ডিপ্রেশনের ঝুঁকি বৃদ্ধি পায়। এটি নিয়ন্ত্রণ করতে সুষম খাদ্য, পর্যাপ্ত ঘুম, নিয়মিত ব্যায়াম এবং মানসিক চাপ কমানো প্রয়োজন। প্রয়োজনে ডাক্তার পরামর্শে হরমোন থেরাপি গ্রহণও সমাধান হতে পারে।
উপসংহার
টেস্টোস্টেরন হরমোন পুরুষদের শরীরের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটি পেশি বৃদ্ধি, শক্তি, যৌন ইচ্ছা, মানসিক স্থিতিশীলতা এবং হাড়ের ঘনত্ব বজায় রাখতে সাহায্য করে। তবে হরমোনের ভারসাম্য নষ্ট হলে, শারীরিক ও মানসিক বিভিন্ন সমস্যা দেখা দেয়। অতিরিক্ত টেস্টোস্টেরনের ফলে আগ্রাসী আচরণ, ব্রণ, চুল পড়া, অনিদ্রা, হৃদরোগ এবং মানসিক অস্থিরতা তৈরি হতে পারে। অন্যদিকে, টেস্টোস্টেরন কমে গেলে পেশি দুর্বলতা, হাড়ের ঘনত্ব কমে যাওয়া, যৌন ইচ্ছা হ্রাস, মানসিক চাপ এবং ডিপ্রেশনের ঝুঁকি বৃদ্ধি পায়।
বাংলাদেশে তরুণদের মধ্যে ফিটনেস বা পেশি বৃদ্ধির জন্য টেস্টোস্টেরন বুস্টার ও স্টেরয়েডের ব্যবহার ক্রমেই বেড়ে চলেছে। এটি শরীরকে সাময়িকভাবে শক্তিশালী করে, তবে দীর্ঘমেয়াদে শরীরের অভ্যন্তরীণ অঙ্গগুলোকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। লিভার, কিডনি, হৃদপিণ্ড এবং প্রজনন অঙ্গগুলোর উপর এর মারাত্মক প্রভাব থাকতে পারে।
সুস্থ জীবনযাপন, সুষম খাদ্য, পর্যাপ্ত ঘুম, নিয়মিত ব্যায়াম এবং মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণ করা হরমোন ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য অপরিহার্য। প্রয়োজনে ডাক্তার বা হরমোন বিশেষজ্ঞের পরামর্শে হরমোন থেরাপি গ্রহণ করা উচিত। হঠাৎ বা অযাচিত হরমোন ব্যবহার করা শরীরের স্বাভাবিক প্রক্রিয়াকে নষ্ট করতে পারে।
টেস্টোস্টেরন সম্পর্কে সচেতন হওয়া মানে শুধু শারীরিক সুস্থতা নয়, মানসিক ও সামাজিক সুস্থতাও নিশ্চিত করা। ভারসাম্যহীন হরমোন কেবল বাহ্যিক শক্তি বা পেশি বাড়ায় না, এটি মানসিক স্থিতিশীলতা, সম্পর্ক ও দৈনন্দিন জীবনকেও প্রভাবিত করে। তাই হরমোন নিয়ন্ত্রণে রাখা, সঠিক জীবনধারা অনুসরণ করা এবং প্রয়োজনীয় চিকিৎসা গ্রহণ করা অপরিহার্য।
সারসংক্ষেপে বলা যায়—হরমোন ভারসাম্য মানে শক্তি, সুস্থতা এবং দীর্ঘমেয়াদে জীবনের মান নিশ্চিত করা। অতি বা কম টেস্টোস্টেরন, যে কোনো অবস্থাতেই সমস্যার কারণ। তাই সচেতনতা, নিয়মিত পরীক্ষা এবং প্রাকৃতিক জীবনধারা অনুসরণ করাই সবচেয়ে ভালো প্রতিকার।
শরীরের অভ্যন্তরীণ স্বাস্থ্য ঠিক রাখলে বাহ্যিক সৌন্দর্য, শক্তি ও আত্মবিশ্বাসও ঠিক থাকে। তাই টেস্টোস্টেরনের ভারসাম্য বজায় রাখা এবং স্বাস্থ্যকর জীবনধারার দিকে মনোযোগ দেওয়া প্রয়োজন। এই বিষয়গুলো মানলে পুরুষরা শারীরিক, মানসিক এবং সামাজিক দিক থেকে সুস্থ জীবন উপভোগ করতে পারবেন।